Sunday, April 26, 2015

রসিক-বেরসিক

থ্রী ইডিয়েটস নিশ্চয় দেখেছেন? ওখানে র‍্যাঞ্চো একটা হেব্বি ডায়ালগ দিয়েছিলো – সেটার সারাংশ ছিল এই যে যখন লোকে প্রেমে পড়ে, তখন হাওয়া বইতে থাকে, দোপাট্টা উড়তে থাকে, পরিবেশটা ফিল্মি হতে থাকে।
ব্যাপারটা মেলড্রামাটিক শুনতে লাগলেও কিন্তু তা নয়।

বিশ্বাস হচ্ছে না?

কোনোদিন হয়েনি বলছেন এরকম?

তাহলে দুটো সম্ভাবনা আছে।
১। আপনি কোনোদিন প্রেম-টেম করেননি, সারাজীবন শুধু ধোপার হিসেব করেছেন, আর লোককে কাঠি করেছেন।

২। নয়েত, এসবই হয়েছে, খেয়াল করেননি।

২ নম্বর ক্যাটেগরি-র লোকেদের জন্যে আমি ব্যাপারটা খোলসা করছি (১ নম্বর ক্যাটেগরি-র লোকেদের জন্যে যেটা বলতে চাইছি, সেটা ভদ্র-ভাষায় লেখা যাবে না এখানে, ক্ষমা করবেন)।

ধরুন আপনি তখন স্কুলে পড়েন, স্কুল শেষে এবার টিউশন যাচ্ছেন।

গিয়ে দেখলেন, তখনো বিশেষ কেউ আসেনি, এই ৩-৪ জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

ভালো কথা, আপনি গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লেন।

৫ মিনিট পর, দেখলেন, আপনার ব্যাচ-র সেই মেয়েটি ঢুকলো, যার প্রতি সব-কটা ছেলের টাল আছে।

(ক্ষমা করবেন, আমি এটা ছেলেদের দিক থেকে লিখছি, মেয়েদের দিক থেকে লেখা সম্ভব না। বুঝেই উঠতে পারলাম না এখনো, তায়ে আবার লেখা!!)

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কারণ এতো রোজ-ই হয়, মেয়েটি ঢোকে, আর সবকটা ছেলে হাঁ করে দ্যাখে (আপনিও তার মধ্যে একজন, মাথা নিচু করে লুকোনোর মত কিছু হয়েনি, ব্যাপারটা স্বাভাবিক)।

কিন্তু আজ হোল ক্যাচাল। মেয়েটি এসে বসল আপনার-ই পাশে (যেটা কোনদিন হয়েনা)।

আপনি অলরেডি ঘামতে শুরু করেছেন। হাতড়ে একটা খাতা বার করে আপনি পড়ার ভান করতে শুরু করলেন এবার।

কি ভাবছেন? কেউ কিছু বোঝেনা!! আপনার ওই বয়েস-র মেয়েরা না!! থাক, আর বললাম না।

বেশ খানিক্ষন চুপচাপ, আপনি ভাবলেন – যাক, বেঁচে গেলাম এযাত্রা (মনে কিন্তু ইচ্ছে শাহরুখ খান হবার, কিন্তু ইয়েতে দম নেই আরকি)।

এইভাবে যখন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করতে শুরু করেছেন, যে আর বোধহয় আজ বেঁচে গেলেন, তখনই মেয়েটি বলে উঠলো – “কিরে, কথা বলছিস না যে!”।

ব্যাস!! যাও ঘাম শুকিয়েছিল, এবার যে কি কি ভিজতে আরম্ভ করলো, বলা মুশকিল!

সেই দিন-টাতে, টিউশন শেষ হবার পর, যখন বাড়ি ফিরলেন, ভেবে বলুন তো, ভর-গরমে বসন্তের হাওয়া মনে হয়েনি!! মিথ্যে বলবেন না।

বাঁই বাঁই করে সাইকেল চালাননি সেদিন!

যে রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরেন, সেই রাস্তা দিয়েই ফিরেছিলেন? নাহ। হতে পারে না।

পাড়ার কুকুর টাকে ২ টো বিস্কিট খাওয়াননি?!

ওই পাড়ার গজাকে, যাকে দেখলেই আপনি খিল্লি করেন রোজ, তার দিকে তাকিয়ে সেদিন অমায়িক হাসেননি বলছেন!! (গজা তো ট্যান, ছেড়ে দিন)

বাড়ি ফিরে, মা জিগ্যেস করেননি – ওরে, জামাটা ছেড়ে ফ্রিজের উপর কেনো রেখেছিস?!

বুঝলেন কিছু?

কি বুঝলেন? দাঁড়ান, আরো একটু আছে।

শুধু স্কুলের বয়েসেই এসব হয় ভাববেন না।

যখন আরেকটু বড় হলেন, কি করতেন তখন? এইরকম কেস ঘটলে?

বাড়ি এসে আপনার প্রিয় গানটা চালিয়ে একা একা ফিল্মি স্টাইলে পুরো ঘর জুড়ে নাচেননি বলছেন?
বিবেক নেই আপনার!! সত্যিটা বললে কি খুব ক্ষতি হবে!

২ টো কবিতা লেখেননি!! মানছি, পাতে দেবার মত নয় সেগুলো, পরে আপনিই হয়েত ছিঁড়ে ফেলেছেন লজ্জা পেয়ে, কিন্তু লিখেছিলেন তো! সেটা কম কথা!

তবে এই যা বললাম, সেগুলো আমাদের সময়ে হত। তাই বলে এটা আবার ভাববেন না যে আমি আর ডাইনোসর-রা এক-ই সময়ের।

তবে আমি এই লেটেস্ট জেনেরশন-র ছেলে-পুলে-দের নিয়ে ঠিক সিওর নই।

এরা আদৌ প্রেম করে বলে তো মনে হয় না, তবে ডেটিং করে।

আর এতো টেকনিকাল ব্যাপার-র সঙ্গে ম্যাজিক খাপ খায়ে না বোধয়।

আমার মনে হয়, এরা যদি প্রেম-এ পড়ে, বাড়িতে ভিডিও গেম-টা সেদিন একটু কম খেলে, আর ফেসবুকে একটা-দুটো এমন স্ট্যাটাস দেয়, বাপের সাধ্যি নেই কেউ বোঝে (নিজেরাও যে বুঝে দেয় তা নয়, তবে সেটা ভাল লক্ষন, কারণ তার মানে বুঝতে হবে যে এমন প্রেম-এ পড়েছে যে কিছুক্ষনের জন্যে অন্তত বাস্তবে ফিরেছে)।

তা সেই যাই করুক, অন্তত কিছু তো করে।

ধোপার হিসেব আর লোককে বসে কাঠি তো করেনা!!

তবে, ব্যাপারটা হল, এই যে এত কিছু বললাম, এগুলো যে শুধু প্রেমে পড়লেই হয়, এমন শুধু নয়।

খুব আনন্দ হলেও হয়।

আবার টেরিয়ে তাকাচ্ছেন!! আশ্চর্য!!

মানতে হলে মানুন, নয়েত যান-না, গিয়ে ২ টো আঁটি বাধুন।

যারা এটা পড়ে, চিত হয়ে বিছানায়ে শুয়ে, সিলিং-র দিকে তাকিয়ে নস্টালজিক হচ্ছে, হতে দিন সেটা, বেরসিক কোথাকার!!

বিস্মৃত

নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এখন।

ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, সোজা গলির শেষ প্রান্তে। পুরো গলিটা দেখা যেত দরজাটা খুলে সামনে বসে থাকলে।

ছেলেটা দুপুরবেলা আসতো।

এসে একটা হাঁক ছাড়তো – “ঠাকুমাআআআ”।

আমার ঠাম্মা ঘরেই থাকতো, হয়েত বসে বই পড়তো, বা কখনও ঊর্দু শিখত নিজে নিজেই।

আমাদের ডাকটা অভ্যেস হয়ে গেছিল।

দরজা খুললে দেখা যেত সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে – আমার বয়েসিই ছিল, সাইকেল করে আসত, তাতে অনেকগুলো মাঝারি থলে ঝুলত, তার মধ্যে থাকত চানাচুর, বিভিন্ন ধরণের – সেগুলো সে বেচতে আসত।
 
সব বাড়ি সে ঘুরত না, শুধু কয়েকটা বাড়ি তার চেনা ছিল, সেখানেই সে বেচত।

না, শুধু চানাচুর বেচত না, সঙ্গে অনেক গল্পও করত।

তার বাড়ির গল্প, তার মায়ের গল্প, আর তার ফুটবল খেলা শেখার ইচ্ছের গল্প। তখনও অতটা বুঝতাম না, কিন্তু ছেলেটা বেশ অন্যরকম ছিল, একটা আত্মসম্মান-ওয়ালা ছেলে, জীবন যুদ্ধে সোজা হয়ে লড়ে যাওয়া একটা ছেলে।

প্রায়ই আসতো, গল্প করে যেত, আর কিছু চানাচুর রেখে যেত।

বেশ ভাল লাগত, ছেলেটা এলে, গতানুগতিক জীবনের বাইরে একটা অন্যরকম হাওয়া।

তারপর, একদিন হঠাত খেয়াল হল একদিন, ছেলেটা অনেকদিন যেন আসেনি।

ঠাম্মা জিগ্যেস করল, ২ সপ্তাহ আগে এল – তাই না রে কাজল?

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, বললাম, হ্যাঁ, ওইরকমই হবে।

আমরা ভাবতাম, এই হয়েত আসবে, হয়েত ফুটবল খেলার সুযোগটা পেয়েছে, আসবে কয়েকদিন পরে।

অপেক্ষা করতাম।

কিন্তু, সে আর আসেনি।

নামটা তখন জানতাম, কিন্তু – আজ আর মনে নেই।

অথবা, উত্তরপাড়া লাইব্রেরীর মাঠে যখন বিকেলে খেলা হত, একটা ছোট্ট ছেলে, ১০-১২ বছর বয়েস হবে, লাইব্রেরীর সিড়িতে বসে আমাদের খেলা দেখত, গালে হাত দিয়ে।

একদিন, খেলার পরে, গিয়ে বসলাম ছেলেটার পাশে।

অন্ধকার হয়ে আসছিল, মাথার উপর কিছু মশা ঘুরে বেড়াচ্ছিল, রোজকার মতন।

হাতের ক্যাম্বিস বলটা ছেলেটাকে দিলাম।

একগাল হেসে নিল।

জিগ্যেস করলাম – বসে থাকো যে এখানে, খেলবে কাল থেকে আমাদের সঙ্গে?

মুখটা হাসিতে ভরে উঠল, বলল – “হ্যাঁ, খেলব, তবে...বাবা বলেছে, যে অসুখ সেরে গেলে তারপর খেলতে”।
 

আমি বললাম, বেশ তো, তাই নাহয় হবে।

কিন্তু বললে না তো – তোমার কি হয়েছে...

ছোট ছেলে তো – প্রশ্নটা শুনে একটু সামস্যায়ে পড়ে গেল বোধহয়।

মাথার টুপিটা খুলে কয়েকবার মাথাটা চুলকে নিল। 

আর আমি খানিক্ষন অর চুলবিহীন ছোট্ট ন্যাড়া মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

খানিক্ষণ পরে জিগ্যেস করলাম – তোমার নাম কি?
 
বলেছিল, কিন্তু আজ আর মনে নেই।

 

আমরা আসলে অনেক কিছু ভুলে যাই, জীবনের স্রোতে অনেক কিছু ভেসে যায়, এটা বোধহয় স্বাভাবিক, কিম্বা নয় – বলতে পারবো না ঠিক।

ছেলেরা যেমন, বিয়ের পরে বিয়ের দিন ভুলে যায় (কেস তারপর কি খায়ে মোটামুটি সবারই জানা আছে, খোলসা করছি না আর এখানে), বউ-র জন্মদিনও মাঝে মাঝে ভোলে (সেম রেজাল্ট), অফিসে বস-র দেওয়া কাজ করতে ভুলে যায় (পাশের মেয়েটার “একটু করে দাও না এটা” বলে দেওয়া কাজটা কিন্তু ভোলে না – কি করা যাবে, ইনসেনটিভ চাই তো নাকি!!), আবার অফিস থেকে বেরিয়ে পাব-এ ঢুকে তারপর বাড়ী ফেরার রাস্তাটা ভুলে যায়।

মেয়েরা যদিও কিছুই ভোলে না, এবং সেটাই সবথেকে বড় সমস্যা। এর জ্বালায়ে ছেলেদের নিজের নাম ভুলে যাবার জোগাড় প্রায়।

 
তবে, এই ভুলে যাওয়াগুলো বেশ মজার, একদিক থেকে দেখতে গেলে।

কারণ, পরে, মনে পড়লে, আমরা নিজেরাই হাসি, এই ভুলে যাওয়া আর তার পরিণাম মনে করে।
 

কিন্তু, কখনও কখনও স্বপ্ন ঘিরে ধরে, আবছা ধোঁয়াশা, যেন একটা মশারীর মধ্যে দিয়ে দেখা – সেই দৃশ্যগুলো, কিছুতেই যেন মনে পড়তে চায় না, ধরা দিয়েও ধরা পড়েনা – সেই ভুলে যাওয়াগুলো, মজা দেয় কি? হয়েত না, জানি না।

 

আস্তে আস্তে বিস্মৃত হওয়া নাম, ঘটনা, দিন, বন্ধু, সময় – সব ভেসে যায় – হয়েত পরে কোনদিন মনে পড়বে যেটা চাই মনে করতে, পাড়ে এসে ঠেকবে স্মৃতিগুলো, কিন্তু তখন হয়েত অনেক দেরী হয়ে যাবে।

 

নাহ, দেখেছেন তো, নামগুলো কিছুতেই আর মনে পড়ল না!!

তবে মনে পড়লে, অবশ্যই আপনাদের জানাবো।

শুঁটকিমাছ

পশ্চিমবাংলার বাইরে, বিশেষত দক্ষিণে আর পশ্চিমে, বাঙালীদের নিয়ে একটু-আধটু খিল্লি যে হয়ে থাকে এটা সবার-ই জানা, যেমন আমরা ওদের নিয়ে করে থাকি আর কি।

তা, “কুঁড়ে”, “ভাবুক-চন্দর”, “বাবু”, এই মধুর তকমাগুলো বাঙালীদের সম্বন্ধে শুনলে এঁড়ে তক্ক করা ছাড়া আর কিছু করার খুব একটা থাকে না। 

কিন্তু একটা ব্যাপার আছে, যেখানে এঁড়ে-বেঁড়ে যে তক্কোই হোক না কেন, কেউ কিছু বললে মাঝে মাঝে রক্তারক্তি হয়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকে।

“মেছো-বাঙালী” -  আমার সমস্ত অবাঙালী বন্ধুরা এবং বাকিরা – ভেবেচিন্তে বলবেন, মাইরি বলছি।

গড়পড়তা বাঙালীর পাতে মাছ থাকাটা রোজকার ব্যাপার।

রুই-কাতলা-মৃগেল-ভোলা-ভেটকি-পাবদা-তেলাপিয়া-পমফ্রেট-চিংড়ি-ইলিশ, এসব বাঙালীর জীবনের নিত্যসঙ্গী।
যেকোনো দুই বাঙালীকে মাছ নিয়ে কথা বলতে বসিয়ে দিন, গোটা একটা বেলা কেটে যাবে, কিন্তু তাও আগামী এক মাসের যুক্তিতক্কো বাকি থাকবে।

আর, এই মাছেদের মধ্যেও শ্রেণীবিভাগ আছে, অনেকটা ওই বামপন্থী রাজনীতির মত (আমি কিন্তু রাজনীতির ব্যাপারে মূর্খ্যই বলতে পারেন, তাই দয়া করে মানহানির মামলা করবেন না)।

রুই-কাতলা-মৃগেল-মৌরলা – এরা হচ্ছে ওই শ্রমিক-কৃষক শ্রেণী। শ্রেণী রাজনীতি নিয়ে এর থেকে বেশী জানতে চাইলে, মার্ক্সবাদ পড়ে নেবেন, আর মাছ নিয়ে আরও জানতে চাইলে বলবেন – পরে আর একটা নাহয় লিখব সব মাছেদের নিয়ে।

পমফ্রেট-পাবদা-ভোলা-ভেটকি – এরা হল ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তবে পুঁজিবাদী বোধহয় বলা যায় না এদের।

আর, ইলিশ-চিংড়ি, এরা হল মাছেদের সমাজে এলিট শ্রেণী।

বোধহয় একটু ভুল বললাম।
এরা মাছেদের সমাজে নয়, মনুষ্য সমাজের ক্ষেত্রেই শ্রেণী বিভাজনটা করে থাকে সাধারণত। তবে, সেই কচকচি আরেকদিন হবে নাহয় পরে।

কিন্তু, এই যে ইলিশ-চিংড়ি, এরা হল গিয়ে আইকনিক, মেগা-স্টার বলতে পারেন।
এদের নিয়ে বাঙাল-ঘটি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান – এরকম হাই-ভোল্টেজ ক্যাচড়া তো অতি পরিচিত বাঙালী সমাজে।

তবে, যেটা কোনদিনই খুব একটা তক্কে আসে না, সেটা হল শুঁটকি মাছ।

এই বস্তুটি কিন্তু পূর্ববঙ্গের লিগ্যাসি। বাঙালদের খাস বিলাসিতা বলতে পারেন।

এরকম একটা বিতর্ক তো আছেই যে, পদ্মার ওপারে বাঙাল, আর এপারে নয়।

আমি কিন্তু এপার-ওপার কোনটাই নই, জন্মও বাংলাদেশে নয়, কিন্তু জন্মসূত্রে বাঙাল বটে।

আর শুঁটকি মাছ আমার জীবনের সেরা খাবারগুলোর মধ্যে একদম উপরে আছে। আর আমি কিন্তু বহু জায়গার বহু খাবার খেয়েছি, আমাকে কুঁয়োর ব্যাঙ ভাববেন না মোটেও।

তাই, বাঙাল আর শুঁটকি মাছ যে একাত্মা, এই ব্যাপারে আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। সুতরাং, আপনি যদি নিজেকে বাঙাল মনে করেন, কিন্তু শুঁটকি মাছ ভালো না বাসেন, দয়া করে ঘরের কোনায় গিয়ে মুখ লুকোন, কারণ এই নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসলে আপনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে এটা আগেই বলে দিলাম কিন্ত।

তো, যাই হোক, এই শুঁটকি মাছ জিনিসটা বেশ মজার। একটু বলি বরং।

সাধারণত, লৈট্যা, লাক্কা আর চিংড়ি – এই তিন ধরনের মাছ থেকেই শুঁটকি তৈরি হয়। ব্যাপারটা কিছুই নয়, এই মাছগুলোকে বেশ অনেকদিন ধরে তেড়ে শুকোনো হয়। তারপর যখন মাছগুলোর মধ্যে আর কোন রসকষ বাকি থাকে না, তখনই ওগুলোকে বাজারে পাঠানো হয় খাদ্যরসিকদের রসনার রসস্বাদন করার জন্যে।

এই শুঁটকি মাছের বেশ চড়া দুর্নাম আছে মার্কেটে। কারণটা বুঝতে আমার ছোটবেলায় বেশী সময় লাগেনি, ঘটনাটা একটু বলি।

বাড়িতে শুঁটকি মাছ রান্না হচ্ছে একদিন সকালে। ভাড়া বাড়ী ছিল, আমরা নিচের তলায়, বাড়িওলরা উপরে। রান্না তখন মাঝামাঝি জায়গায়, চারিদিক বেশ ম-ম করছে, হঠাৎ দেখি বাড়িওয়ালা মাসিমা নাকে কষে আঁচল চাপা দিয়ে নিচে নেমে এসেছেন, আর আমার মা-কে বলছেন – “আঁরঁতিঁ, তোঁমাঁর রাঁন্নাঘঁরে কিঁ কিঁছুঁ পঁচেছেঁ? আঁমরাঁ উঁপর থেঁকেঁ এঁকটা ভঁয়ঙ্কঁর মঁড়াপঁচা গঁন্ধ পাঁচ্ছি।”

খুব একটা অতিরঞ্জিত ছিল না বোধহয় ব্যাপারটা। আসলে, যারা কোনদিন এই বস্তুটির সঙ্গে পরিচিত হয়েনি, তাদের ক্ষেত্রে শুঁটকি মাছ রান্নার সময়ের গন্ধটা সহ্য করাটা অনেকটা ভুতেদের মোচ্ছবে বসে থাকার মতই লাগে হয়ত।

কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার চরম লাগত ওই গন্ধটা।

শুঁটকি মাছ রান্নার গন্ধ নাকে ঢোকা মানেই আমার খিদে পাওয়া শুরু। সেই খিদে ওই যে সকাল ১০-১১ টা থেকে পেতে শুরু করত, আগ্নেয়গিরির লাভার মত সেই খিদেটা ১-টা নাগাদ দুপুরের খাবার পাতে বিস্ফোরন হত। রোজ যা ভাত খেতাম, এই দিনটাতে তার থেকে অন্তত দ্বিগুণ খাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
খাওয়ার পাতে, ওই যে একটা লালচে, তেল-রগরগে, বিষম ঝাল বস্তু পাতে এসে পড়ত, তার যে কি স্বাদ, সে যে কি জিনিস, মাইরি বলছি, আমার অত ক্ষমতা নেই যে সেটা আপনাদের লিখে বোঝাব।

সেটা বুঝতে গেলে আপনাদের ওই স্বর্গীয় বস্তুটির রসস্বাদন করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।

বেশ অনেক রকম শুঁটকি মাছের রান্নাই আমি খেয়েছি, এদিক-ওদিক অনেক বাঙালদের হাতে, কিন্তু, মা যেটা বাড়িতে বানাতো, সেটা একটা অন্য জিনিস ছিল, একদম অন্য জিনিস।

অনেকবার মা খাইয়েছে সেই শুঁটকি মাছ।

একদিন বলল, আগামী রবিবার করব, আসিস খেতে।

সেই রবিবারটা এসেছিল ঠিকই, কিন্তু শুঁটকি মাছ রান্না করার জন্যে মা আর ছিল না।

স্বাদটা চিরকাল মনে থাকবে।

তাই কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, যে অনেকদিন খাওয়া হয়নি, একদিন চেষ্টা করেই দেখি না রান্না করার।

রান্না তো আর শুধু রেসিপি নয়, তার সঙ্গে স্মৃতিও, হয়ত ওরকমই বানিয়ে ফেলব।