Sunday, November 6, 2016

পাগলছানা

ওই যে আছে ঘোর-প্যাঁচানি, মুখটা করে হাঁড়ি
সাতসকালেই বলবে উঠে, আজকে শুধু আড়ি

সারা দুপুর ফুলে আছে, ঘাড়ের কটি রোঁয়া
কানের থেকে যাচ্ছে বয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া

ঝটপটিয়ে ঝাপটে ডানা, আশপাশে তার আসতে মানা
বিড়বিড়িয়ে বকছে কিসব, কাগের নয়ত বগের ছানা

ভাবছ বুঝি আপনভোলা, মাথায় আছে অঢেল ছিট
ভুল নয়কো, ঠিকই, তবে পেলেই তোমায় করবে টিট

দেখতে ওরম ভোম্বলরাম, মোটেই নয়কো হাঁদা
ওপর থেকেই ঝাপটে ডানা, লাগায় চোখে ধাঁধা

সত্যি বলছি, অ্যাইসা জোরে, ধরতে হবে কানদুটো
বাদ যাবে না, মিলিয়ে নিও, একটা-দুটো চুলমুঠো

চিড়বিড়িয়ে, তিড়বিড়িয়ে, যেই না দেবো কিলচাঁটি
রাগটা ব্যাটা, সেই পালাবে, দেখতে গিয়ে চোখদুটি

Thursday, November 3, 2016

ছোটবাবু

হেড অফিসের ছোটোবাবু, লোকটি বেজায় শান্ত
শুধু সকাল থেকে রাতের বেলা, দেখায় উদভ্রান্ত

ঝাঁকড়া চুলে পাখির বাসা, গোটাকয়েক উকুন তায়
ধরে পাশে বসিয়ে দিলে, ভামের ব্যাটাও অক্কা পায়

জামার রঙটি ধরতে পারে, এমন কারুর সাধ্য নেই
বলবে যখন অনেক কথা, সামনে কেবল বসতে নেই

বলবে যাহা, নাড়বে মাথা, বাবু আমার বাধ্যটি
চেয়ার থেকে ওঠায় তাকে, এমন কারুর সাধ্য কি!

কাজ পড়েছে, অনেক বুঝি? না হে, তোমার চিন্তা নেই
মনের সুখে আরাম করো, তোমার কাজও করবে সে'ই

যতই করো লম্ফঝম্প, যতই বলো "তফাৎ যাও"
লাভ নেইকো! ঠ্যাংটি তুলে, আরাম করে লস্যি খাও

দিনের শেষে, রাতের বেলা, আপিস যখন বেবাক খালি
ওই দেখোনা, এক কোনাতে, জ্বলছে আলো একটি খালি

রাত হয়েছে, ভাবছো বুঝি, ছোটোবাবু ফিরবে কি?
মিছেই তুমি ভাবছ এত, দাঁড়িয়ে আছে ট্যাক্সিটি

আপনমনে গুড়গুড়িয়ে, পেরিয়ে সিঁড়ির প্রান্তটি
যে যাই বলো, মানতে হবে, লোকটা বড় শান্তটি!

Friday, September 30, 2016

অবাকখুড়ো

সবাক-বনের অবাকখুড়ো, দুলতো দোলা দোলনাতে
আকাশপানে দেখত চেয়ে, মন ছিল না খেলনাতে

দিনের বেলা মেঘের খেলা, কিংবা কিছু শালিক-চিল
সেই না দেখেই, দুইপা নেচে, বলত খুড়ো "ছু-গিল-গিল"

কিন্তু যদি বৃষ্টি হত, পড়ত জোরে জলের তোড়
অমনি খুড়ো, আগুন জ্বেলে, রাঁধত একটা আস্ত থোড়

শীতের বেলায়, একটু যখন, ঠান্ডা হাওয়া বইত বেশ
গাছের নীচে চুপটি বসে, বাঁধত কষে চারটি কেশ

ভোরের বেলায়, চারটি কলা, রাখত ভাঙা আয়নাতে
দুপুর হলে দশটি মুলো, রাতের বেলায় খায় না সে

ভাবছ জানি - লিখছে কিসব, গেছেই বোধহয় মাথাখানি
চোখটি বোজো, অমনি পাবে, সবাক-বনের হাতছানি

Saturday, May 14, 2016

উল্টোপাল্টা


শ্যামবাজারউত্তর কলকাতাবুধবার

প্রতিদিন ঘড়ি ধরে ভোর পাঁচটায় উঠে বস্তির সামনের টিউবওয়েলটা থেকে দুবালতি জল ভরেসেটা দিয়ে আধঘন্টা ধরে চান করাটা নিধুখুড়োর আজন্মকালের অভ্যেস!

আর সেই চানপর্বের জলের ঝপাস ঝপাস আওয়াজআর সঙ্গে খুড়োর উচ্চস্বরে গাওয়া বেসুরো শ্যামাসঙ্গীতের সমস্বর কোলাহলে রোজই অখিলের ভোরের সুখের ঘুমটার বারোটা বাজে!

যদিও ঘড়ি ধরে” কথাটা আক্ষরিক অর্থে ঠিক নয়কারণ নিধুখুড়ো ঘড়ি দেখতেই জানে না। আর সেই সত্যটা অখিল আবিস্কার করেছিল অনেক পরেকয়েকবছর আগে যেদিন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন নিধুখুড়ো সকাল ১১ টা নাগাদ সন্ধ্যের চা-মুড়ি নিয়ে বসে পড়েছিল! আর তারপর গ্যাস-অম্বল বাধিয়ে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির একশেষ!
তারপর অখিল নিধুখুড়োকে একটা ঘড়ি কিনে দিয়ে সময় দেখা শেখাতে চেষ্টা করেছিল বটেকিন্তু সে চেষ্টা পুরোপুরি গঙ্গার জলে ভেসে গেছে!

সাধারণত প্রতিদিন এই সময়টা ঘুম চটকে যাবার পরে অখিল আর একবার  ঘুমোবার চেষ্টা করে থাকেকিন্তু আজ কেন জানি আর ঘুমোতে ইচ্ছে করল না!
আসলেকালই অখিলের কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছেতাই কাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঘন্টাচারেক ঘুমিয়ে পড়েছিলতাই সেই অর্থে আজ আর সেরকম ঘুম পাচ্ছে না।

ঘুম ভেঙ্গে খাটের উপর উঠে বসল অখিল। পাশে রাখা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ছোট্ট খুপরি জানলার পাশে রাখা জলের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে এই নিধুখুড়োর কথাটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
যখন সে জানত না যে খুড়ো ঘড়ি দেখতে জানে নাততদিন অবধি রোজ কাঁটায় কাঁটায় এই ভোরে উঠে চান করাআর সারাদিন যথাসময়ে দৈনন্দিন কাজকম্মগুলো করার মধ্যে কোনো আশ্চর্য ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সেই সূর্যগ্রহণের দিন থেকেই এটা অখিলকে ভাবাতে শুরু করেছিলএকটা মানুষ কি করে প্রতিদিন একটুও সময়ের ভুল না করে কাজ করতে পারে ঘড়ি দেখতে না জেনেওসেটা অখিলের কাছে সত্যিই অভাবনীয় ছিল!
কমার্সের ছাত্র হলেওঅখিলের সায়েন্সের দিকে একটা স্বাভাবিক ঝোঁক আছে। নিজের ইচ্ছেতেই ও বেশ কিছু সায়েন্সের বই পড়ে আর অল্পসল্প ইন্টারনেট ঘেঁটে বেশ কিছু তথ্য আর জ্ঞান অর্জন করেছিল। খুড়োর এই ব্যাপারটা চোখে পড়ার পর থেকেই তাই সে এটার কারণ খোঁজার পেছনে উঠেপড়ে লাগে। আর তার স্বভাবসুলভ অধ্যাবসায়ের ফলে মাসখানেকের মধ্যেই এর প্রাথমিক উত্তর অখিল পেয়েও যায়!
শারীরবৃত্তীয় ঘড়িবা বডি ক্লক জিনিসটা সম্বন্ধে তার ধারণা পরিস্কার হয় তখনই। আর নিধুখুড়োর বহুবিধ মজাদার কার্যকলাপ তখন বদলে যায় অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং ব্যাপারস্যাপারে!

কয়েক ঢোক জল খেয়ে বোতলটার ছিপি এঁটে জানলায় রাখার পরই অখিলের ব্যাপারটা খেয়াল হল!
কইঝপাস ঝপাস জলের আওয়াজআর সঙ্গে বেসুরো শ্যামাসঙ্গীতএগুলো তো শোনা যাচ্ছে না!
হুড়মুড় করে খাট থেকে নেমে চটিটা গলিয়েই অখিল হন্তদন্ত হয়ে বেরোলো দরজা দিয়ে। জানলা দিয়ে টিউবওয়েলটা দেখা যায় না, কারণ সেটা ওদের ঘরের পশ্চিমের দেওয়ালের পাশেই পড়ে বলেআর জানলাটা আছে দক্ষিণ দেওয়ালে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরতেই অখিলের চোখে পড়ল টিউবওয়েলটা।

ফাঁকাকলের নিচের শানবাঁধানো এবড়োখেবড়ো মেঝেটাও শুকনো!
আর, বাকি চারিদিক শুনশান – রোজ এসময়ে যেরকম থাকে, সেরকমই।

খানিক্ষণ ভেবলে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়াল হল, হাতঘড়িটা তো বালিশের পাশে খুলে রাখা আছে রোজকার মত। মাঝরাতে উঠে পড়লাম তাহলে – অখিল ভাবল!
ফিরে গিয়ে বালিশ সরিয়ে হাতঘড়িটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে তাকাতেই অখিল প্রায় পড়ে যাচ্ছিল! একি!! ঘড়িতে তো আটটা বাজে! চোখ কচলে নিয়ে আরেকবার তাকালো অখিল, দু-একবার ঝাঁকালো ঘড়িটাকে – নাঃ, এত সেই আটটাই দেখাচ্ছে!
পাশের ঘরে উঁকি মারল অখিল। ওর ভাই-বোন সেখানে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, বাবা কদিন ধরেই বাইরে আছে কাজের সূত্রে। আস্তে করে ঘরে ঢুকে দেওয়ালঘড়িটার দিকে তাকালো অখিল।
যাহ তেরিকা, এখানেও তো আটটাই দেখাচ্ছে!
আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের কলতলার শানবাঁধানো মেঝেতে হতভম্ভ হয়ে বসে পড়ল অখিল! তাহলে কি সারাদিন ঘুমোলো সে, যে একেবারে রাত আটটায় ঘুম ভাঙল?!
কিন্তু, তাহলেও তো, রাস্তায়, পাড়ায় লোকজনের ভিড়, দোকানপাটের ব্যস্ততা – এসব থাকার কথা! কই, চারিদিক তো শুনশান! মনে তো হচ্ছে মাঝরাত!

এবার একটু আতঙ্ক চেপে বসল মনে! এত শ্মশানপুরী মনে হচ্ছে! সবাই বেঁচেবর্তে আছে তো?
এটা মনে হতেই অখিল ধড়ফড় করে উঠে ছুটল বস্তির ভেতরের দিকে, স্বপনকে ডাকতে হবে! রকি বোধহয় নাইট ডিউটি করেছে কালকে, কিন্তু ভজন আর আঠার বাড়িতেই থাকার কথা! একছুটে স্বপনের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে টেঁপিদের ঘরের সামনে রাখা স্তুপাকৃতি টিনের বাক্সগুলো লাগল অখিলের কাঁধে।

বিকট খ্যানখ্যানে আওয়াজ করে হুড়মুড়িয়ে পড়ল গোটা স্তুপটা! সাড়ে সব্বনাশ, অখিল ভাবল, এবার তো গোটা পাড়া উঠে পড়বে ডাকাত পড়েছে ভেবে!
অখিল আর দাঁড়ালো না, ছুট লাগালো ডানদিকের গলিটা ধরে।


সুন্দর মহল, মেরিন ড্রাইভ, মুম্বাই, বুধবার

ঘুম ভাঙার পরও আলসেমিটা আজ যাচ্ছিল না কিছুতেই!

পরপর পাঁচরাত টানা কাজ করার ফল এটা, বুঝতে পারছিল রূপসা। কিন্তু কিছু করারও নেই – বড় বাজেটের ছবি, আর ওর এটা প্রথম বড় ব্রেক – হাড়ভাঙ্গা খাটুনিটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই তাই।
তবে আজ ছুটি, শ্যুটিং এর। পুরো ইনডোরের কাজটা শেষ হল কাল। এবার একটা তিনদিনের ছুটির পর কিছু অল্পস্বল্প ডাবিং আছে, তারপর সোজা মিশর, আউটডোর শ্যুটিং এর জন্যে।
মিশর!! ভাবতেই রূপসার বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল! এই ২২ বছর বয়সেই এরকম সুযোগ এসে যাবে, এটা একেবারে অভাবনীয় না হলেও, আশাতীত তো ছিল বটেই! সেই আনন্দে আজ ঘুমটাও তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে গেছে, নাহলে একটা ক্লিওপেট্রা মার্কা স্বপ্ন বেশ গড়গড়িয়েই দেখছিল রূপসা!

সুবোধ দা কে একটা হাঁক দিয়ে এককাপ কড়া কালো কফি বানাতে বলতে গিয়েও থেমে গেল রূপসা। নাঃ, আজ একটু নিজেই কফি বানানো যাক।
দশ মিনিট পর একটা বড় মগের সাইজের কাপে ধোঁয়াওঠা কফি নিয়ে, লাখ-পনেরো টাকা দিয়ে ছবির মত সাজানো বসার ঘরের টিভিটা খুলল রূপসা। অলসভাবে টিভির চ্যানেল বদলাতে বদলাতে, কফির কাপে হালকা চুমুক দিতে দিতে, সামনে রাখা ইকেবানা সম্বন্ধীয় ম্যাগাজিনটা হাতে তুলে ওলটাতে গিয়েও থমকে গেল রূপসা।

কি বলছে এটা, ব্রেকিং নিউজে!?
এসব কি উল্টোপাল্টা খবর বলছে?! কফির কাপটা তাড়াতাড়ি টেবিলে নামিয়ে রেখে টিভির চ্যানেল বদলালো – কিন্তু এটাতেও তো একই খবর, একই অদ্ভুতুড়ে কথা! পরপর আরো কয়েকটা চ্যানেল বদলালো রূপসা, কিন্তু সব চ্যানেলেই একই খবর!

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে, একবার দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো রূপসা, তারপর ধীর পায়ে উঠল। আস্তে আস্তে বিশাল স্লাইডিং দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে, খুব সাবধানে, বেলজিয়াম থেকে আনা ভারী কাপড়ের পর্দাটা হাল্কা একটু সরিয়ে তাকালো বাইরের দিকে!

ম্যাগাজিনটা হাত থেকে কখন খসে পড়েছে মেঝেতে, খেয়াল ছিলনা রপসার!

অবাক চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, যেখানে এখনো রাতের ঘন অন্ধকার, কিন্তু তার দেওয়ালঘড়ি, আর সমস্ত খবরের চ্যানেল বলছে – এখন সকাল সাড়ে দশটা!

সুরেলা শব্দে ফোনটা বেজে উঠতে সম্বিৎ ফেরে রূপসার। টেবিলের উপর রাখা মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে বাবার নম্বর – ফোনটা তুলে নেয় রূপসা।

“হ্যাঁ, বাবা”

“আরে, তোকে কতক্ষণ থেকে ফোনে চেষ্টা করছি, বেজেই যাচ্ছে, তুই কোথায়?!”

এঃ, ঘুম থেকে ওঠার পর তো ফোনটা আর দেখাই হয়নি!
“না বাবা, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিল!”

“আরে শোন, দেখেছিস কি উল্টোপাল্টা কান্ড হয়েছে!? আমি তো এদিকে সকাল থেকে, ইয়ে, মানে গত দু ঘন্টা ধরে বাবাইকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছি, এদিকে তারও কোনো ফোন লাগছে না! কি মুশকিল হল বল দেখি!”

“ওহ, তাই বুঝি! শোনো বাবা, আমি ঠিক আছি, বাড়িতেই আছি এখন। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি বরং একবার দেখি ভাইকে ফোনে পাই কিনা। রাখছি, পরে তোমায় ফোন করছি ওকে পেলে।“

ফোনটা কেটে দিয়ে রূপসার মনে হল যে এই ঝটকার পর থেকে তার মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে, নয়ত ভাইয়ের কথাটা আগে মনে পড়া উচিৎ ছিল তার।
রূপসা তার ফোন থেকে ভাইয়ের বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল।

বাবাই, পোষাকি নাম অভিক, রূপসার ছোট ভাই, কিছুদিন আগে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। প্রচন্ড মেধাবী ছাত্র, আর সেইমাত্রায় ডানপিটে! উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পরেই একটা চিঠি আসে বাড়িতে – কখন নিজের খেয়ালে কিসব এঁকেবুঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ই-মেলে, সেই আইডিয়া তাদের পছন্দ হয় – তাই নাসা থেকে তারা ডেকে পাঠায় অভিককে, এক মাসের জন্যে, ওয়াশিংটনে। গত মাসেই সে গেছে, এবং মাঝে মধ্যেই দিদিকে ই-মেল করে তার অ্যাডভেঞ্চারের কথা লিখে পাঠায়!
রূপসার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ভাইয়ের খোঁজ নেওয়া ছাড়াও, এই অদ্ভুত কান্ডের কারণটা নিয়েও সম্ভবত সেই আলোকপাত করতে পারবে!

নাঃ, কলটা বাবাইয়ের ভয়েস মেসেজে চলে গেল। রূপসা ভাবল যে একটা মেসেজ ছেড়ে রেখে দেবে, কিন্তু তার আগেই লাইনটা কেটে গেল নিজে থেকেই!

ফোনটা হাতে নিয়ে রূপসা ফিরে এল টিভির সামনের সোফাতে, আর সরিয়ে রাখল দরজার সামনের পর্দাটা। টিভির পর্দায় ক্রমাগত দেখিয়ে যাচ্ছে ব্রেকিং নিউজ – গোটা দেশজুড়ে রাত্রির অন্ধকার, সমস্ত লোকজন ভেঙে পড়েছে রাস্তায়, বহু লোকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, মন্দিরে-মসজিদে, বিভিন্ন পূণ্যস্থানে পুজো দেবার হিড়িক লেগেছে, রাস্তায় নেমেছে পুলিশ, এমনকি মিলিটারিও!
বিভিন্ন চ্যানেলে ভেসে আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছবি, লোকে লোনারণ্য শহর-গ্রামের রাস্তাঘাট।
কলকাতা চিড়িয়াখানার পশু-পাখিদের আচরণে অদ্ভুত ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে কিছু চ্যানেলে দাবী করছে!
হঠাত রূপসার খেয়াল হল – তাই তো, মেনি গেল কোথায়!?
একছুটে ঘরে ঢুকল রূপসা – নাহ, মেনি তার জায়গায় নেই, টেবিলের উপর বাস্কেটটা ফাঁকা! ঝুঁকে খাটের তলায় উঁকি মারল রূপসা, কিন্তু না, সেখানেও নেই মেনি! সব্বোনাশ, গেল কোথায় সে!
রান্নাঘর? ছুটল সেখানেও রূপসা, কিন্তু সেখানেও তার টিকিটি দেখা গেল না!!
এইবার যখন তার মাথায় হাত দিয়ে বসার উপক্রম, তখনই খেয়াল হল রূপসার! সোজা আবার বসার ঘরে ছুটে গেল সে, আর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বইয়ের আটফুট উঁচু তাকের উপর উঁকি মারল। 
যা ভেবেছিল তাই, মেনি তাকের উপর এক কোনায় গুটিসুটি মেরে সেঁধিয়ে আছে! ভাগ্যিস, রূপসার মনে ছিল, আগের বার সেই কানফাটানো বাজ পড়ার পরে সুবোধ দা এখান থেকেই খুঁজে বার করেছিল মেনিকে!
হাত বাড়িয়ে ঘেঁটি ধরে মেনিকে টেনে আনতে হল  রূপসাকে। শেষমেষ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে তার ফ্যাঁসফ্যাঁসানি কিছুটা শান্ত হল!
ধীরপায়ে বসার ঘরে ফিরে এল রূপসা – মেনিকে চেয়ারের উপর রাখা তাকিয়ার উপর বসিয়ে দিয়ে সে গিয়ে দাঁড়ালো স্লাইডিং দরজার পাশে। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে প্রায় পুরো শহরটা দেখতে পাচ্ছিল রূপসা, আর ভাবছিল – আজ সে কিছুটা আতঙ্কিত, এবং তার থেকেও বেশী হতভম্ব, কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে, বা গ্রীনল্যান্ডের মত জায়গায়, অথবা উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া অভিযাত্রী দলগুলো – সেখানকার মাসছয়েকের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলো তো সেখানকার বাসিন্দাদের অসাচ্ছ্যন্দে ফেলে না!
আসলে, অভ্যেসের থেকে আলাদা কিছু, রোজকার রুটিনের থেকে অন্য কিছু – এগুলোই আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

এই উপলব্ধিটা এই অদ্ভুত মূহুর্তেই হতে হল!
সকাল এগারোটায় এই রাতের অন্ধকারের মধ্যেও হাসি ফুটে উঠল রূপসার মুখে।


মল্লিকঘাট, কলকাতা, বুধবার

গঙ্গার ঘাটে সুন্দর মৃদুমন্দ হাওয়ায় অখিলের পাঞ্জাবির কোনাটা উড়ছিল। ওরা পাঁচজন বসে ছিল ঘাটের সবথেকে নিচের সিঁড়িটাতে – স্বপন, রকি, ভজন, আঠা আর অখিল। সামনে গঙ্গার ওইপার থেকে নতুন সূর্যটা উঁকি মেরেছে এই কিছুক্ষণ আগে, এখনো যার মধ্যে হলুদ ভাবটা লেগে আছে।
ঘড়িতে এখন রাত দশটা প্রায়। সকলের চোখেমুখে গত দশ-বারো ঘন্টার মানসিক ধকলের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তার সঙ্গে অখিলের চোখে লেগে আছে এক অন্য মুগ্ধতা, আর সঙ্গে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি।

মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল কিছু সারস। মাছধরা জেলেনৌকোগুলো দাঁড় টেনে চলেছে গঙ্গার মাঝের দিকে।

মোবাইল ফোনটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালো অখিল – এবার ফিরতে হবে। আজ এক নতুন দিন, নতুন সময়ের সঙ্গে অখিলও খুঁজে পেয়েছে তার নতুন লক্ষ্য!


সুন্দর মহল, মেরিন ড্রাইভ, মুম্বাই, বুধবার

সাদা ঝকঝকে ফোনটা ফোনটা তখনো হাতে নিয়ে বসে ছিল রূপসা। এই মিনিট পনেরো হল বাবাইয়ের ফোনটা এসেছিল। ভাইয়ের কথাগুলোই এখনো ভেবে যাচ্ছিল সে।
খুব উত্তেজিত শোনাচ্ছিল ভাইয়ের গলা, যখন ফোন করেছিল।

“জানিস দিদি, আমাদের পৃথিবীটা আজ, মানে তোদের মাঝরাত নাগাদ, আস্তে আস্তে ঘোরা থামিয়ে, আবার উল্টোদিকে ঘোরা শুরু করেছিল, আর তার ফলেই এই উল্টোপাল্টা অবস্থা!”
উল্টোদিকে ঘুরছে মানে!!! শুনে রূপসারই মাথা কোনদিকে ঘুরতে শুরু করেছিল সেটা আর এখন খেয়াল নেই!
“এই ব্যাপারটা নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক বিজ্ঞানীরা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন কারণটা খুঁজে বার করতে। কিন্তু সবথেকে বড় ব্যাপার কি জানিস! আমি তখন সবে লাঞ্চ করতে করতে আমার ই-মেল দেখছিলাম। দেখলাম একটা মেল এসেছে ইন্ডিয়ার একটা ছেলের থেকে। এর সঙ্গে মাস ছয়েক আগে কলেজ স্ট্রীটে বই কিনতে গিয়ে আমার আলাপ হয়েছিল। পৃথিবীর চৌম্বকমেরু অদলবদল নিয়ে এক বিজ্ঞানীর একটা থিয়োরির বই খুঁজছিল, খুব অবাক হয়েছিলাম ওরকম অদ্ভুত কৌতুহল দেখে! সেই সুত্রেই আলাপ হয়েছিল – আমি বলেছিলাম পেলে আমি ওকে ই-মেল করে দেব। সে-ই আজ একটা মেল করেছিল আমাকে, যেখানে থেকেই আমি জানতে পারি যে ইন্ডিয়ায় সকাল দশটাতেও রাতের অন্ধকার। তখনই আমি ছুটি আবার প্রফেসরের ডেস্কে। কিন্তু সবথেকে অদ্ভুত জিনিস কি জানিস দিদি? ও মেলে লিখেছিল যে সেই বিজ্ঞানীর থিয়োরি থেকে ওর মনে হচ্ছে যে পৃথিবীর উল্টোদিকে ঘোরার একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে, যেটা সাধারণত ২ লক্ষ্য থেকে ৩ লক্ষ্য বছর পরে পরে হবার সম্ভাবনা।  আমি এই কথাটা আমার প্রফেসরকে বলেছিলাম গিয়ে। কথাটা যে ভুল নয়, সেটা তো দেখাই গেল! ভাবতে পারছিস দিদি, ইন্ডিয়ার এক বস্তিতে থাকে ওই ছেলেটা, সেরকম কোনো সুযোগসুবিধে নেই পড়াশুনো করার, অথচ কি দুর্দান্ত জ্ঞান আর কিউরিওসিটি!

বাবাই আরো খানিক্ষণ বকবক করেছিল উত্তেজিত স্বরে।  রূপসা বুঝতে পারছিল ভাইয়ের এই উত্তেজনার কারণ – এই বয়সে, যখন স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল তুঙ্গে থাকে, সেই সময়ে আমেরিকাইয় নাসায় বসে এরকম একটা যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পরেও যে ও মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে সেটাই বেশ অবাক ব্যাপার! সেই তুলনায় প্রথম সিনেমায় ব্রেক পাবার পর রূপসা তো লাফাতে গিয়ে পড়ে পা-ই মচকে ফেলেছিল – রোলটাই প্রায় হাতছাড়া হবার যোগাড় হয়েছিল!

বাবাই আরো কিছু বলেছিল – কিভাবে এখন সময়ের হিসেব করা হবে, বা দিনক্ষণ-তারিখেরই বা কি হবে – কিন্তু সেসব ভালো করে মাথায় ঢোকেনি রূপসার। আপাতত সে এটাই বুঝেছে যে, পৃথিবী অন্যদিকে ঘুরুক বা রাত দশটায় সূর্য সবে হলুদ থেকে সাদা হোক, পেট তার নিজের কাজ করে যাবে!
কি অদ্ভুত – ভাবল রূপসা!
নাহ, ফ্রিজে ডিম আছে, আর একটু নুডলস – একটু চাউমিন বানানোই যেতে পারে। আরেকবার পেটটা ডাকার আগেই উঠে পড়ল রূপসা, রান্নাঘরের দিকে – পায়ে পায়ে লেগে থাকা মেনির ল্যাজ বাঁচিয়ে।


ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দিল্লী
নতুন বার

গত বারো ঘন্টায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে বিমান চলাচল। কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্যে বসে বসে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ফ্লাইট বাতিল হবার ঘোষণা আর চারিদিকের শোরগোল শুনে ঘুম ভেঙে দেখি এই কান্ড!

ব্রাতিস্লাভা ফিরে যাচ্ছি আজ মাসদুয়েক কলকাতায় কাটানোর পর। জানি না আবার কবে ফিরব! সামনে অনেকগুলো কাজ, লম্বা সময় ধরে অনেকগুলো ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্ট আছে, ইউরোপের বেশ কিছু অংশও ঘুরতে হবে সেই সুত্রে।
আর আধঘন্টাখানেক পরই প্লেন ছাড়বে – দুবাই হয়ে ব্রাতিস্লাভা – লম্বা সফর।

ফোনটা পকেটে নড়েচড়ে উঠল, হোয়াটস্যাপে বোধহয় মেসেজ এল! ফোনটা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে মনে পড়ল, কলকাতায় এয়ারপোর্টে বসে থাকতেই ফোনটা এসেছিল।
প্রথমে খানিক ইয়ারকি-ফাজলামি, হাল্কা ঝগড়াঝাটি। তারপর খানিক্ষণ এদিক-ওদিক কথাবার্তা চালানোর পর আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা বাড়ছিল!
আমি বললাম, ওখান থেকে ছবি পাঠাবো, অদ্ভুত সুন্দর সব জায়গার।
খানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলেছিল – “আচ্ছা”!
তারপর কয়েকটা লম্বা নিঃশব্দ শ্বাস ছাড়ার পর বলেছিল – “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, তারপর একদিন সারাদিন বসে গল্প শুনব তোমার অ্যাডভেঞ্চারের”!


নাহ, সূর্যটা আজ সত্যিই পশ্চিমদিকেই উঠেছিল!


নিজের অজান্তেই হেসে পকেটে আবার ফোনটা ঢুকিয়ে রাখলাম। ব্যাগকাঁধে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম প্লেনের দিকে।

Saturday, February 6, 2016

ল্যাজ

আজ পর্যন্ত সবথেকে বড় সেলিব্রিটি ল্যাজ হচ্ছে পবনপুত্র হনুমানের।

গপ্পোটা আপনারা সবাই জানেন, সেই লঙ্কাকান্ডের ব্যাপারটা। ভেবে দেখুন – একটা গোটা রাজত্বের বেশ একটা বড় অংশের সত্যানাশ করে দিয়ে এসেছিলেন ভদ্রলোক! থুড়ি, ভদ্রহনু!

ভেবে দেখবেন, ব্যাপারটা মোটেই হেলাছেদ্দা করার মত নয়। আগুন লাগাতে হত – হাতে করে মশাল নিয়ে যাওয়া যেত! চাইলে ওই ফোলা গালের মধ্যে করে একটা বড় সাইজের সুতলি বোমা নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু না, তিনি কি করলেন?! ল্যাজে করে আগুন লাগালেন!!

প্রভুভক্তি দেখানোর আর রাস্তা ছিল না!!

সাধে কি লোকে বলে, ওই যে দিদির ল্যাজ মদনা যাচ্ছে!!

তবে, আপনাদের কোন ধারণা আছে যে এই ল্যাজ কি বিষম দরকারি বস্তু?
বলছি শুনুন।

প্রাণীজগতে, এই ল্যাজ একটি অত্যন্ত দরকারি অঙ্গ। কখনো কাঠবেড়ালিকে ছুটতে দেখেছেন? বা গাছে উঠতে-নামতে? বা কোনো বাঁদরকে এবাড়ি থেকে ওবাড়ির ছাদে লাফিয়ে যেতে?
লক্ষ্য করবেন, এদের ল্যাজগুলো এই সময়ে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদিক-ওদিক নড়তে থাকে ক্রমাগত। আসলে, এই ল্যাজ হচ্ছে ওদের ব্যালেন্স রাখার মূল অঙ্গ।

শুধু তাই নয়। আপনার পাশের বাড়ির সদ্য কলেজ পাশ করা মটকা-ঝটকা দিয়ে অযথা এঁকেবেঁকে চলা মামনির পোষা ভোলা যখন আপনাকে দেখে ল্যাজ নাড়ে, আপনি বোঝেন যে তার খুব আনন্দ হয়েছে। আর আপনি ভোলার সেই আনন্দের ছুতো করে একটু হাবিজাবি বকে নেন!!
ভেবে দেখুন তো, যদি ভোলার মালকিনেরও একটা ল্যাজ থাকত, তাহলে কত সহজেই না আপনি বুঝতে পারতেন যে সেও আপনাকে দেখে আনন্দ পেয়েছে কিনা! নাহলে, একজন মেয়ের মুখ দেখে বুঝবেন, এত বড় শর্মা তো আপনি নন!!

এখন মানবেন তো ল্যাজের উপকারিতা?

তবে এই হুনুমানের ল্যাজ কিন্তু ছোটবেলায় আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন টিভি তে রামায়ণ সিরিয়াল দেখাতো, আর আমি বেশ মন দিয়েই দেখতাম। আর সেইসব উচ্চমার্গের যুদ্ধবিগ্রহ দেখার পর আমার সেগুলো নকল করার বেশ একটা অদম্য ইচ্ছা হত।
বেত বেঁকিয়ে ধনুক বানানো, বা পাটকাঠি দিয়ে তীর, এইসব আমি করেছিলাম বটে। এমনকি মহাভারতের ভীমের গদাও আমার কাছে সুপারহিট হয়েছিল।

তবে যেটা সবথেকে বেশী এখনও যেটা মনে আছে, সেটা হল হনুমানের ল্যাজ!
মূলধন তো সেরকম কিছু ছিল না সেই সময়ে। তা একদিন হনুমানের লঙ্কাকান্ডের জ্বালাময়ী এপিসোড দেখার পর পাড়ার মাঠে বেরিয়েছি রোমাঞ্চকর ব্যাপারটাকে একটা বাস্তব রূপ দেবার ইচ্ছায়। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছি মাঠে, আর ভাবছি যে একটা ওরকম আকর্ষণীয় ল্যাজ তো বানাতেই হয়! এরকম ভাবতে ভাবতেই – ইউরেকা!! পেয়ে গেলাম। মাঠে একটি পেঁপেগাছ থেকে ঝুলছে একটি প্রায়-শুকনো ডাল।

দেখেছেন কি পেঁপেগাছের শুকনো ডাল? বলে দি বরং।

যে দিকটা গাছে লেগে থাকে, সে অংশটা একটু মোটা হয়। তারপর একটু হালকা করে বেঁকে ডালটা নেমে আসে নিচের দিকে। আর শেষে আরেকটা হালকা উপর দিকে বাঁক মেরে শেষ হয় বেশ একটা ঝুপসো পাতায়। পাতাটা অনেকটা ওই তাসের চিড়িতনের মত দেখতে, শুধু ধারগুলো একটু কোনাচে হয়।

নিলাম পেড়ে। ডালটা। হাতটা পেছনদিকে বেঁকিয়ে দিলুম গুঁজে পিছন দিকে প্যান্টুলুনের উপর দিকে। আপনারা ঠিক ব্যাপারটা কল্পনা করতে পারছেন কিনা জানিনা, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আসল হনুমানেরও এত ভালো ল্যাজ ছিল না!!

গন্ডগোলটা হল তার পরে। ডালটা যে গাছে ছিল, আর গাছে যে পিঁপড়ে ছিল সেটা আমি ঠিক তখন ভেবে উঠতে পারিনি উত্তেজনার বশে!! তারপর, কি আর বলব – লঙ্কাকান্ড লঙ্কাকান্ড!!!!!

এমন একটা জিনিস নিয়ে লিখতে বসলাম যা কিনা আমাদেরই নেই!! মোটামুটি মানুষ ছাড়া, প্রাণীজগতের আর বাকি সবারই ল্যাজ আছে। বিভিন্ন আকার এবং প্রকারের – তবে আছে। মোটা, সরু, ছোট, বড়, লোমশ, টিংটিঙে – সব পাবেন।

আমাদেরও নাকি শরীরে এমন একপিস হাড় আছে যেটা এককালে নাকি ল্যাজের অংশ ছিল। মেরুদন্ডের একদম শেষের হাড়, নাম হচ্ছে কসিক্স (coccyx), যেটি ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে এখন শুধুই একটি হাড়।

দেখুন দিকি, আমাদের লাফালাফি তো কমেনি, বরং বেড়েইছে, তবু আমাদের ল্যাজ লোপ পেয়েছে!! আর সেইজন্যেই বোধহয়, আমাদের ব্যালেন্সটা ক্রমাগত হড়কে যাচ্ছে দিনকে দিন!!

আবার, এই ল্যাজ নিয়ে কিছু প্রবাদ বাক্যও চালু আছে। যেমন ধরুন সাপের ল্যাজে পা দেওয়া! আমি যদিও বেশ আতান্তরে পড়ি সাপের ঠিক কোনটা ল্যাজ সেটা খুঁজে বার করতে, তবে মোটামুটি ওই লিকলিকে পুরোটাই ল্যাজ ধরে নিয়ে দূরে থাকাটাই আমার চিরকাল শ্রেয় মনে হয়েছে!

তবে একবার আদর করে বাড়ির সবথেকে শান্ত মেনি বেড়ালটার ল্যাজ টেনে দিয়েছিলুম। উরেব্বাপ!!! এমন ফ্যাঁস করেছিল যে আমার তো প্রায় টাকে উঠে ঘোরার যোগাড় হয়েছিল!!

তারপর অনেকদিন সেই অপোগন্ডটাকে খুঁজেছিলাম যে শালা বলেছিল যে শুধু সাপের ল্যাজেই পা দিলে নাকি...

তা, কয়েকদিন ধরেই এইসব ভয়ানক ভাবনাচিন্তা করতে করতে মনে হল যদি আমাদের একটি করে ল্যাজ থাকত, তাহলে কি কি সুবিধা বা অসুবিধা হত!!

ধরুন, আপনি আজ কাজে একটা দারুণ প্রশংসা পেয়েছেন আপনার বসের কাছে। সবার সামনে বেশ পিঠ চাপড়ানি-টানি খেয়ে আপনি নিজের জায়গায় ফিরলেন। মেজাজ ফুরফুরে। হালকা করে ল্যাজটা এদিক-ওদিক দোলাতে থাকুন – দেখবেন মেজাজটাই পুরো সিংহ রাজের মত হয়ে যাবে!!

আবার ধরুন, সেই রাতেই, আনন্দের চোটে আপনি অফিস থেকে বেরিয়ে এট্টু পানভোজন করে রাত করে বাড়ি ঢুকলেন। এবং ঢুকে বুঝলেন যে আপনি ফেরার পথে বাজার করে আনতে ভুলে গেছেন, যেটা সকালেই আপনাকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল।
কি করবেন? খুব সহজ – ল্যাজটা একটু নেতিয়ে নিয়ে নিজের চারপাশে হালকা গোল করে পেঁচিয়ে নিয়ে বসে থাকুন, দেখবেন ঝাড়টা একটু হলেও কম পড়বে। হাজার হোক – সহানুভুতি বলেও তো কিছু জিনিস আছে!!

ওই সেই “অবতার” সিনেমা তে দেখিয়েছিল না, যে কিরকম সব ল্যাজে-ল্যাজে বেশ মেলামেলি হচ্ছে, আর কিসব বন্ধন তৈরি হচ্ছে!!

ধরুন আপনি বসে আছেন, কোনো জনবহুল জায়গায়। পাশে আপনার প্রেমিকা। খুব হাত-টাত ধরতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সবার সামনে ঠিক পারছেন না। হালকা করে ল্যাজটা একটু এগিয়ে নিয়ে যান, টুক করে গিয়ে প্রেমিকার ল্যাজে টুক করে জড়িয়ে নিন – ব্যাস, সমস্যার গদগদ সমাধান!!

প্রেমিকা রাগ করে হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে?! কুছ পরোয়া নেহি, তার হাত আপনার হাতের বাইরে গেলেও, ল্যাজ তো আপনার হাতের নাগালেই আছে, নাকি!! হাঁ করে দেখছেন কি?? ধরুন চেপে!!
তবে হ্যাঁ, খুব জোরে চাপবেন না – ওই ল্যাজে পা পড়ার প্রবাদটা একটু মনে রাখবেন কিন্তু!!

আবার কিছু মুশকিলও আছে।

দলে বসে আড্ডা মারছেন বন্ধুবান্ধব মিলে, ইচ্ছে হল একটু বান্ধবীর সঙ্গে খুনসুটি করবেন। চুপি চুপি ল্যাজ দিয়ে তার ল্যাজে বোলাতে লাগলেন। বেশ খানিক পরে কোনো সাড়া না পেয়ে যখন তাকালেন, দেখলেন যে তার পাশের সুর্পনখা টাইপের মেয়েটি বেশ লাজুক হাসছে আপনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে!! করলেন তো রং নাম্বার!!!

সবথেকে বড় মুশকিল অবশ্য অন্য জায়গায়! চোখের উপর কি লাগাবো, লিপস্টিক কি রঙের হবে, চুল সোজা থাকবে নাকি খোঁপা, কানে কটা দুল পরব, জামার রঙ কিসের সাথে মানাবে, জুতো কি হাই-হিল নাকি প্ল্যাটফর্ম – এই মহাভারতেই তো পৃথিবীর অর্ধেক সমস্যা আটকে আছে!! তারপর যদি আবার ল্যাজ যোগ হয়!!! সেই ল্যাজের পরিচর্যা, ওয়্যাক্সিং, রুপচর্চা – ভাবলেই আতঙ্ক লাগছে না কি!!

আর এরপর বাকি রইল প্রেম-বিবাহ সম্পর্কিত বিপদ!!

প্রেমিকা প্রেমিককে পরিত্যাগ করল। কারণ?
কলেজের আরেকটি মেয়ে কথা বলতে বলতে ছেলেটির ল্যাজে একটু হাত বুলিয়েছিল!! কাঁহাতক সহ্য করা যায়!! সত্যিই তো!!

বা ধরুন, কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপন বেরোল – পাত্র সবর্ন ব্রাহ্মণ, উচ্চতা ৫’১”, সরকারি চাকুরিরত, একমাত্র সন্তান, ফর্সা, একটি পুরুষালি ল্যাজের গর্বিত অধিকারী। বিবাহপোযোগী সুপাত্রীরা যোগাযোগ করুন। ল্যাজহীন কন্যারা মাফ করবেন।

অথবা – পাত্রী স্নাতক, গৃহরতা, সঙ্গীতশিল্পে এবং রন্ধনশিল্পে পটিয়সী (দুই হাত এবং ল্যাজের সাহায্যে নিপুণভাবে এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিভিন্ন পদ রাঁধিতে সক্ষম – পরীক্ষা প্রার্থনীয়)!!

শাশুড়িরাও আর একটি অস্ত্র পাবেন তাদের বৌমাদের পেছনে লাগতে।
“বৌমা – তুমি সেই আবার ল্যাজ না ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছ!!”
অথবা...
“বৌমা – তুমি জানো না আজ বাড়িতে নিরামিষ, আর তুমি ল্যাজে করে থালাটা মুছলে!!”

কি বিতিকিচ্ছিরি কান্ড দেখুন তো!! ল্যাজ থাকলেও তো বিপদ!!

এক কাজ করুন না, চলুন না বরং আবার ফিরে যাওয়া যাক সেই বিবর্তনের পথে - তবে এবার পেছন দিকে। হয়ত ল্যাজ ফিরে আসবে, আর তার সঙ্গে কিছু বোধবুদ্ধি!

সবসময় পিছনে ফিরে যাওয়া মানে কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া নয়!

Saturday, January 2, 2016

হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার

- হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার দাদা!

- আরে পাঁচু যে!! হ্যাপি নিউ ইয়ার, হ্যাপি নিউ ইয়ার! তা, আছো কেমন?

- এই তো দাদা, আপনাদের দয়ায় ভালোই চলছে।

- উলটো বললে পাঁচু, তোমার দয়ায় বরং আমরা বেঁচেবর্তে আছি। তা আজ সকাল সকাল বাজারে যে! কাল রাতে পার্টি করোনি?!

- আর বলবেন না দাদা, কপালটাই খারাপ!

- কেন কেন? দোকান বন্ধ হয়ে গেছিল বুঝি? আগে থেকে তুলে রাখোনি? অবশ্য তুমি চাইলে বন্ধ দোকানও খুলে দেবে, তবু!!

- হে হে, খিল্লি করছেন দাদা!! না দাদা, অন্য কেস।

কয়েকদিন আগে মালতিকে বলেছিলাম যে লতুন বছরে একটা লতুন শপথ লেবো, ওই যে রিজোলিউশন না কি যেন বলেন আপনারা, সেইটে।

- বাঃ এ তো ভালো কথা! তা কেসটা খেলে কেন?

- ওই শপথ লিয়ে দাদা। মালতিকে বলেছিলাম পরের বছরে আর মাল খাবো না। তাই এই বছরের শেষ মাল খাওয়ার জন্যে সব জিনিসপত্তর রেডি করে রেখেছিলাম আগে থেকেই। বেশ মাঝরাত থেকে জমিয়ে বসব বলে যেই না বোতল খুলেছি, আর বলবেন না দাদা, বৌ এসে বলল তুমি না শপথ লিয়েছিলে আর খাবে না! আমি বললাম – মালতি, সে তো কাল থেকে রে, এই আজকেই তো লাস্ট। তখন কি বলল জানেন!! বলল যে এখন তো ঘড়িতে বারোটা বেজে গেছে, আর বারোটা বেজে গেলে জানো না পরের দিন পড়ে যায়!! ব্যাস, এমনভাবে বলল মালতি, আমাকে সব আবার তুলে দিতে হল!! কি ফাস্টু খেলাম মাইরি জানেন!!

কোন শালারা এই নিয়মটা করেছিল জানেন দাদা?! সকাল না হলে কখনও পরের দিন হয় নাকি??

- হা হা হা হা! তোমার বৌ তো বেশ বুদ্ধিমতী হে পাঁচু!

- তা দাদা, সত্যিই কি রাত বারোটার পর পরের দিন হয়?

- হ্যাঁ ভাই পাঁচু, তা তো হয়।

- কি মুশকিল!! মাঝরাতে কেন নতুন দিন শুরু হয় দাদা?!

- বেশ কঠিন প্রশ্ন করলে তো হে পাঁচু! হুম, দাঁড়াও বলছি, তার আগে মাছটা ওজন করতে বলে দি সঞ্জু কে।
ওহে সঞ্জু, বলছি যে পাবদাগুলো ভালো হবে কি? তাহলে গোটা ছয়েক…

- আরে দাদা দাঁড়ান, আজ আপনাকে মাছ আমি খাওয়বো। সঞ্জু, সবকটা পাবদা তুলে দে তো দাদাকে।

- আরে দাঁড়াও দাঁড়াও পাঁচু, পাগল হলে নাকি!! তুমি হঠাত করে করে খাওয়াতে যাবে কেন হে!! আর সবকটা মাছ নিয়ে কি শেষে পেটখারাপ করে মরব নাকি গো!!

- এই আপনাদের বড় বড় লোকেদের পোবলেম দাদা, কিছু মোচ্ছব না হলে কিছু করতে পারেন না আপনারা! ঠিক আছে দাদা, বৌদিকে বলবেন লতুন বছরে পাঁচু মাছ খাইয়েছে। আরে, তুই হাঁ করে কি দেখছিস সঞ্জু, দিয়ে দে মাছগুলো!!

- মরেছে, তুমি তো আজ মাছ খাইয়ে ছাড়বে দেখছি!! আচ্ছা শোনো শোনো, সবকটা মাছ নিয়ে তো পেট খারাপ করে লাভ নেই, তুমি বরং ওই গোটাচারেক দাও সঞ্জু।

- আপনারা সব পেটপাতলা লোক দাদা!! চারটে মাছ নিয়ে গেলে বৌদির সামনে আমার পেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে না!! সঞ্জু – আটটা মাছ তোল দাদার জন্যে। না দাদা, আর কোনো কথা নয়, মাছ ওই আটটাই, আর আপনি আমাকে ওই মাঝরাতে দিন হবার ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন তো ততক্ষণ।

- সে তুমি আজ কোনকিছুতেই আমাকে ছাড়বে না সেটা বুঝে গেছি! চলো এই রকটায় বসি যতক্ষণ মাছটা কাটা হচ্ছে।

...

...

দেখো পাঁচু, এই মাঝরাতে পরের দিন শুরু হবার ব্যাপারটা এমনিতে বোঝা কঠিন নয়, কিন্তু আমরা চট করে ধরতে পারি না কারণ আমরা ১২-ঘন্টার ঘড়ি দেখতে অভ্যস্ত।

- দাদা, ঘড়ি তো ১২-ঘন্টারই হয়!! ১৩-ঘন্টার ঘড়ির কথা কোনদিন তো শুনিনি!

- আরে না না, ১৩ ঘন্টার নয়, কিন্তু আমাদের একটা গোটা দিন তো ২৪ ঘন্টার হয়, তাই না? রাত ১২ টা থেকে দুপুর বারোটা, আবার সেখান থেকে রাত ১২ টা – ২৪ ঘন্টাই তো হল, তাই না?

- তা তো হল দাদা, কিন্তু…

- বলছি বলছি। ১২ ঘন্টা দিয়ে মাপা ছাড়াও, ২৪ ঘন্টা দিয়ে সময় মাপার আরেকটা পদ্ধতি আছে হে পাঁচু। এক কাজ করো, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লাগানো ঘড়িটা দেখো একবার তাকিয়ে। দেখো এখন দেখাচ্ছে ০৮-১৮, তাই তো? এবার বলো তো, কি করে বুঝবে এখন সকাল আটটা নাকি রাত আটটা?

- কি যে বলেন দাদা, সকালবেলা তো আলো থাকবে, আর রাতে অন্ধকার!! আমাকে বোকা বানাচ্ছেন দাদা!!

- আরে না না পাঁচু। আচ্ছা ধরো তুমি একটা ঘরে বন্ধ আছো, সেখানে বাইরের আলো বা অন্ধকার কিছুই দেখতে পাচ্ছো না, তখন কি করে বুঝবে?

- এই জন্যেই তো বলি যে এইসব ফ্যাকড়ায় না গিয়ে, আলো ফুটলে কাজে বেরিয়ে পড়ুন, আর অন্ধকার নামলেই বোতলটা খুলে বসে পড়ুন!

- সে তো হল, কিন্তু তাতে কি তুমি বুঝতে পারবে যে মাঝরাতে কেন তুমি কাল কেস খেলে এক বছরের জন্যে?

- ঠিক বলেছেন দাদা। না না, আপনি আমাকে বোঝান তো। কি করে ব্যাপারটা বুঝব বলুন তো ওই অন্য ঘড়িতে।

- ব্যাপারটা সোজা। ২৪-ঘন্টার ঘড়িতে সময় শুরু হয় ০০-০০ থেকে, আর শেষ হয় ২৩-৫৯ এ। তারপর আবার শুন্য থেকে শুরু। এই ঘড়ির হিসেবে সকাল আটটা হল ০৮-০০, আর রাত আটটা হল ২০-০০, আগের সঙ্গে ১২ যোগ করে দিলেই হিসেব সহজ। বুঝলে হে পাঁচু?

- অ্যাই সঞ্জু, একটা বিড়ি দে তো।

- হে হে। আরে তুমি প্রথমবার শুনছ বলে একটু কঠিন লাগছে, অভ্যেস হয়ে গেলে দেখবে খুব সোজা। তুমি বরং রোজ কয়েকবার করে এই প্ল্যাটফর্মের ঘড়িটা দেখবে। আর তোমার প্রশ্নের উত্তর হল, যেহেতু শুন্য থেকে দিন শুরু হয়, আর এই ০০-০০ মানে রাত ১২ টা, তাই মাঝরাতেই তুমি কাল কেসটা খেয়েছো। বুঝলে হে?

- বুঝলাম দাদা। আপনি আর কদিন আগে বোঝাতে পারতেন আমাকে, তাহলে আর…

- শোনো পাঁচু, তুমি সময়ের ব্যাপারটা না বোঝার জন্যে দুভাবে লাভবান হয়েছ – সেটা কি ভেবে দেখেছ?

- কি লাভ হল দাদা? আমি তো সবটাই লোসকান দেখছি!!

- এক তো, তুমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ, সেটা লাভ তো বটেই। আর তার জন্যে তোমার মালতিও খুশি হয়েছে কতটা দেখবে – তাই না? আর দ্বিতীয়, এই চক্করে তুমি একটা নতুন জিনিস শিখেও গেলে। সবটাই তো লাভ হে!

- এইটে খারাপ বলেননি দাদা, মালতি খুশি হয়েছে বটে! আজ বলেছে বাজার থেকে খাসির মাংস আনতে, রগরগে করে বানাতে বলব।

- আরে বাঃ পাঁচু, এ তো বছরের দারুণ শুরু হে!! কিন্তু তাহলে তো মাংসটা আনতে হবে – অজিতের দোকান তো? অলরেডি সাড়ে আটটা বাজে তো গো, এরপর তো আবার খাসির ভালো জায়গাগুলো আর পাবে না!

- পাঁচু কাঁচা কাজ করে না দাদা, সে আমি আগেই সাঁট করে এসেছি। অজিত আগেই আমার মাল সরিয়ে রেখে দিয়েছে।

- বাঃ, তাহলে তো কোনো চিন্তাই নেই। এক কাজ কর তাহলে পাঁচু, মাছটাও হয়ে গেছে দেখছি, তোমার মাংসটাও নিয়ে নাও, তারপর চলো নাড়ুর দোকানের কচুরি খাওয়াই তোমাকে, তারপর নাহয় বাড়ি ফেরা যাবে। কি বলো?

- এইটে গামা বললেন দাদা। চলুন আপনাকে আজ নাড়ুর পেশাল কচুরী খাওয়াবো।

- খাবো, কিন্তু এটা তোমাকে আমি খাওয়াবো। না, কোনো আপত্তি শুনছি না। চলো, বছরের শুরুটা আরো একটু জম্পেশ করা যাক।

- চলুন দাদা। তবে আমি তো প্রতি হপ্তাতেই নাড়ুর কচুরি খাই, আজ পেশাল কি হবে সেইটে বুঝলাম না! বছরের শুরু, মাঝখান, শেষ – সবই তো একই হয় দাদা। বরং আপনি বলতে পারেন যে ওই পুজোর সময় আমার ব্যাওসা টা বেশ রমরমিয়ে চলে। ওইসময়ে দাদা আমি বেশ পেশাল মাল খাই একটু!!

- হুম, কথাটা মন্দ বলনি হে পাঁচু!!

- হ্যাঁ দাদা, এই লতুন বচ্ছরের ধুমটা ওই যত সাহেবদের ক্যালানেপনা!! আমাদের কি পয়লা বোশেখ নেই!!

- তা যা বলেছ পাঁচু। ওহে নাড়ু, দু জায়গায় কচুরি দাও তো দেখি, গরম গরম।

- বসুন দাদা – অ্যাই ঘনা, টুলদুটো এগিয়ে দে তাড়াতাড়ি!

...

...

- আঃ, বেড়ে করেছে কিন্তু ভাই, তোমার এই স্পেশাল কচুরি!! সকালটা জমে গেল তো!

- এ তো রোজই করে নাড়ু!! আপনি আজ পেশালটা প্রথম খাচ্ছেন তো, তাই আপনার লাগছে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন দাদা, এই হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার টা নিয়ে সবাই এত ন্যাকামো করে কেন বলুন তো!! পয়লা জানুয়ারি র সঙ্গে অন্য দিনের কি তফাৎ আছে দাদা?

- হুম, এটা দারুণ বলেছ!! কথাটায় যুক্তি আছে। দেখো পাঁচু, আমরা যে ক্যালেন্ডার দেখি, তাতে জানুয়ারি থেকে বছর শুরু হয়, আর ডিসেম্বরে শেষ। কিন্তু আগে এরকম ছিল না ব্যাপারটা।

- কি বলছেন দাদা, আমি তো সেই কবে থেকে দেখে আসছি জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর!!

- আরে হ্যাঁ, আমি বলছি অনেক আগের কথা, মানে যখন রোমান সাম্রাজ্য ছিল। সেটা ধরো আজ থেকে মোটামুটি ২১০০ বছর আগের কথা।

- কি বলছেন দাদা, এই তো ২০১৬ সাল পড়ল, ২১০০ বছর আগে কি করে হবে!!

- আরে পাঁচু, এটা তো যীশুখ্রীস্টের জন্মের পর থেকে ২০১৬ বছর হল, কিন্তু তার আগেও তো লোকজন ছিল, তাদেরও তো দিন গোনার জন্যে কিছু একটা লাগত, আর সেখানেই একসময়ে এই রোমান ক্যালেন্ডার বেশ বিখ্যাত ছিল। আর সেই রোমান ক্যালেন্ডার থেকেই বদলাতে বদলাতে আমাদের আজকের ক্যালেন্ডার এসেছে। গপ্পোটা মজার – শুনবে নাকি?

- বলুন বলুন!

- সেই সময়ে, বছরে ১০ টা মাস ছিল, আর মাসে মোটামুটি ওই ৩০ দিন করে। আর মাসের নামগুলো বেশ অর্থবহ ছিল।

- কি “বহ” বললেন দাদা?!!

- অর্থবহ – মানে হচ্ছে যে কথাটার বেশ সুন্দর মানে আছে। যেমন ধরো, সেপ্টেম্বর – রোমান সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী “সেপ্টো” মানে হল সাত, আর সেপ্টেম্বর ছিল সাত নম্বর মাস। একইভাবে অক্টোবর, নভেম্বর আর ডিসেম্বর!

- সে কি দাদা, সেপ্টেম্বর তো ৯ নম্বর মাস আমাদের!!

- হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আমাদের এখনকার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, যেটাকে বলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারে ১২ মাস, আর আরো নিঁখুত করে বলতে গেলে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৯ মিনিট ১২ সেকেন্ড। কিন্তু রোমান ক্যালেন্ডারে ছিল সব মিলিয়ে ৩০৪ দিন। সেই অনুযায়ী তোমার হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার হত যে সময়ে, সেটা এখনকার মার্চ ধরো।

- কিসব হিসেব বললেন মাইরি!! নাড়ু, আরো চারটে কচুরি দে তো এদিকে, মাথাটা ঘেঁটে গেল পুরো!!

- হা হা! এতো কিছুই নয় পাঁচু, মায়ান-দের ক্যালেন্ডারও বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। মায়ান কারা জানো তো?

- ওপাড়ার মায়া-কে চিনি দাদা, কিন্তু মায়ান!!

- আরে না না, এ অন্য মায়া!! তুমি তো ফুটবল দেখো, ওই যে মেক্সিকো টিম খেলে না, বা হন্ডুরাস - ওইসব দেশ যেখানে, ওইসব জায়গাতেই ছিল একটা উন্নত সভ্যতা, যার নাম ছিল মায়া সভ্যতা। সেইসব লোকেদের বলে মায়ান।

- আপনি মাইরি হেব্বি জ্ঞানী লোক!!

- আরে ধুর, সেরকম কিস্যু না, এ তো আজকাল ইন্তারনেটেই পাওয়া যায়। তো যাই হোক, সেই মায়া-দের ক্যালেন্ডার ছিল আবার দুরকম। তবে যেটা মোটামুটি লোকে জানে সেটাকে বলা হত “হাব”। সেই ক্যলেন্ডারে একটা মজার জিনিস ছিল এই যে, গোটা ৩৬৫ দিনই ছিল ওদের, কিন্তু তার মধ্যে ৩৬০ দিন ছিল ১৮ টা মাসে ভাগ করা, প্রতি মাসে ২০ দিন করে। সেই হিসেবে হয় তোমার ৩৬০ দিন। এবার পড়ে থাকল হাতে আর ৫ টা দিন!! এই পাঁচটা বেনামী দিনকে একসঙ্গে বলা হত “ওয়ায়েব”। মায়ানরা বিশ্বাস করত যে এই পাঁচদিনে মনুষ্যজগত আর আত্মাদের দুষ্টজগতের মধ্যে একটা সুড়ঙ্গ খুলে যায়, আর সেই রাস্তা ধরে দুষ্ট আত্মারা মানুষের মধ্যে চলে আসে অনিষ্ট করতে। তাই সেই সময়ে তারা পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বেরত না।

- ওরেসশালা!!

- এ তো গেল আগের দিনের কথা। এখনকার কালেও কতরকম ক্যালেন্ডার আছে জানো!!

- হ্যাঁ দাদা, বাংলা আর ইনজিরি – এই দুরকম।
দাদা, দুটো জিলিপি দিতে বলি?

- অবশ্যই, জিলিপি তো খেতেই হবে!! দাও দুটো।

শোনো, বাংলা আর ইংরাজি ক্যালেন্ডার ছাড়াও আরো অনেক রকম ক্যালেন্ডার আছে। তবে সবকটা নিয়ে আজ বলতে গেলে যা সময় লাগবে তাতে তোমার বৌদি আমাকে ঘরছাড়া করবে, আর তোমার মালতিও তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। তাই এই জিলিপিটা খেতে খেতে আজ আর একরকম ক্যালেন্ডারের কথাই বলব।

- বলুন দাদা। তবে আরেকদিন কিন্তু আপনার সঙ্গে বসতে হবে, আপনার থেকে এই গপ্পোগুলো শুনতে হেব্বি লাগছে কিন্তু!!

- বেশ তো, সে বসলেই হয় আরেকদিন। আপাতত এই গপ্পোটা বলে ফেলি। তুমি তো চাইনিজ খেতে খুব ভালোবাসো দেখেছি, প্রায় রোজই তো মনা-র দোকানে দাঁড়িয়ে চাউমিন আর চিলি চিকেন খাও।

- র‍্যাপচিক বানায় কিন্তু দাদা, একদিন খেয়ে দেখবেন।

- সে আমি খেয়েছি, ভালোই বানায়। কিন্তু এই চাইনিজ যাদের খাবার, সেই চাইনিজ দের কিন্তু একটা আলাদা ক্যালন্ডার আছে। এরা এখন যে ক্যালেন্ডারটা ব্যবহার করে, সেটার সুত্রপাত হয় প্রায় ৪০০ বছর আগে। অবশ্য তাতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ওটাই মূল।

- কি বলছেন দাদা, চাইনিজ মাল ৪০০ বছর টিকে আছে!! আমার মোবাইল তো শালা ৪ মাসও চলে না!!

- হা হা!! এটা হল গিয়ে আধুনিক চৈনিক সস্তার কারিগরি। কিন্তু প্রাচীন চৈনিক জিনিস কিন্তু রীতিমত টেকসই হত। শুধু তাই নয়, প্রথম চৈনিক ক্যালেন্ডার তৈরি হয় এখন থেকে মোটামুটি ২২০০ বছর আগে।

- তার মানে তো সেই যীশুদাদুর জম্মের আগে, তাই না দাদা?

- বাঃ, এই তো তুমি হিসেবটা বেশ বুঝে গেছ!!

- কি যে বলেন দাদা, আপনি জলের মত বুঝিয়ে দেন যে!

কিন্তু, তাহলে তো, তখন শুধু হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার ছিল, কিন্তু হ্যাপ্পি কিসমাস তো ছিল না!! এ তো ফুল্টু লস দাদা!! কিসমাস ছাড়া নিউ ইয়ার হয় নাকি!!

- তাই তো দেখছি ভায়া! আর এই চৈনিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এবছর তাদের নিউ ইয়ার পড়েছে আমাদের ক্যালেন্ডারের ৮ ই ফেব্রুয়ারি তে। আর জানো তো, আমাদের এই কলকাতায় চৈনিকদের বেশ বড় সংখ্যায় উপস্থিতি আছে। তবে তুমি যদি ওদের নিউ ইয়ার উদযাপন দেখতে চাও, সোজা চলে যাও ট্যাংরা অথবা টেরিটি বাজার। ওখানেই সব কলকাতার চৈনিকরা এসে জড়ো হয় নিউ ইয়ার মানাতে, সারা সপ্তাহ ধরে গান-বাজনা আর ড্রাগন নাচ চলে, আর সেটা শুরু হয়ে যায় প্রায় আসল দিনের ১ সপ্তাহ আগে থেকেই। তাহলেই ভেবে দেখো হে পাঁচু, শুধু নিউ ইয়ারের দিনটা নয়, তার আগের দিনগুলোও বেশ হ্যাপ্পি!

বেশ, চলো এবার ওঠা যাক, সাড়ে নটা বাজতে চলল প্রায়। এবার গিয়ে বাজারটা নামাতে হবে, নাহলে আবার কাজের মেয়েটা তার আগেই ঘর মুছে দিয়ে চলে গেলে পরে তোমার বৌদি খুব রেগে যাবে।

- বাঃ দাদা, দারুণ কিছু খবর দিলেন তো, একবার মালতিকে নিয়ে যেতে হবে দাদা ওদের এই উৎসব দেখতে। মালতি আবার ওই দৈত্য-দানো নাচগান দেখতে হেব্বি ভালোবাসে মাইরি!! চলুন দাদা, আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি যাবার পথে।

- না না, তুমি আবার কষ্ট করবে কেন! আমি রিক্সা করে চলে যাচ্ছি।

- এই দাদা আপনাদের ভদ্দরলোকেদের এক পবলেম!! এত মিনমিন করবেন না তো, চলুন, উঠে বসুন তো বাইকে।

- আজকে মনে হচ্ছে তোমারই দিন। চলো ভাই পাঁচু, তাই সই। নাও, চালাও ভাই।

...

...

- না দাদা, এইসব পেশাল দিন-টিন আপনাদের জন্যেই ঠিক আছে, আমাদের দাদা যেদিন ব্যাওসা ভালো, সেদিনই হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার। তবে জানি না কেন সবাই শালা এটাকে হ্যাপ্পি বলে!! এই তো লাস্ট বছরের পত্থম দিনেই আমাদের বস্তির চন্দনের মেয়ে হল। চন্দন ফিরছিল গোঘাটা থেকে ওর কারবার ভুতোর হাতে দিয়ে। ধম্মতলায় বাস থেকে নামার পরেই শালা বাপির ছেলেরা ঠুকে দিয়ে চলে গেল, তক্কে তক্কে ছিল আগে থেকেই!! আবার সেই বছরই দেখুন, শম্পা সরকারী চাকরিটা পেয়ে গেল পরপর চারবার চেষ্টা করার পর! নিউ ইয়ার ছাড়া কি হ্যাপ্পি হয় না দাদা, সব হয়!! আমাদের নিতাই দাদু আজ সকালেও রোজকার মতই ভোর ৬ টায় রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছে। আমাদের নাহয় আজ একটু মস্তি করার দিন, কিন্তু আপনার বাড়ির কাজের মেয়েটা তো আসবে কাজ করতে!! ওসব হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার ফিয়ার বলে কিছু হয় না দাদা, সবই বড়লোকেদের ফাট্টুবাজি দাদা, বুঝলেন!!

নিন দাদা, লেমে পড়ুন। গিয়ে বৌদিকে বলবেন যে পাঁচুভাই হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার বলেছে।

- অবশ্যই বলব ভায়া। আর তুমি বাড়ি গিয়ে দুপুরে জম্পেশ করে একটা মাংস-ভাত সাঁটিয়ে দিও কিন্তু।

- যা বলেছেন দাদা। আচ্ছা দাদা, আবার একদিন আপনার কাছে গপ্পো শুনব নাহয় সময় করে, আজ চললাম।

- হ্যাঁ এসো ভাই।

...

...


ও হ্যাঁ, পাঁচু ভায়া, বাড়ি গিয়ে তোমার মালতিকে বোলো যে সে যদি ওই দৈত্য-দানো নাচ দেখতে চায়, তাহলে তোমাকে নিয়ে যেন চলে আসে ৮ ই ফেব্রুয়ারি – তোমার বৌদিরও আবার মালতির মতই ওইসব খুব পছন্দ – একসাথে যাওয়া যাবে নাহয় দেখতে!