Sunday, April 26, 2015

বিস্মৃত

নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এখন।

ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, সোজা গলির শেষ প্রান্তে। পুরো গলিটা দেখা যেত দরজাটা খুলে সামনে বসে থাকলে।

ছেলেটা দুপুরবেলা আসতো।

এসে একটা হাঁক ছাড়তো – “ঠাকুমাআআআ”।

আমার ঠাম্মা ঘরেই থাকতো, হয়েত বসে বই পড়তো, বা কখনও ঊর্দু শিখত নিজে নিজেই।

আমাদের ডাকটা অভ্যেস হয়ে গেছিল।

দরজা খুললে দেখা যেত সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে – আমার বয়েসিই ছিল, সাইকেল করে আসত, তাতে অনেকগুলো মাঝারি থলে ঝুলত, তার মধ্যে থাকত চানাচুর, বিভিন্ন ধরণের – সেগুলো সে বেচতে আসত।
 
সব বাড়ি সে ঘুরত না, শুধু কয়েকটা বাড়ি তার চেনা ছিল, সেখানেই সে বেচত।

না, শুধু চানাচুর বেচত না, সঙ্গে অনেক গল্পও করত।

তার বাড়ির গল্প, তার মায়ের গল্প, আর তার ফুটবল খেলা শেখার ইচ্ছের গল্প। তখনও অতটা বুঝতাম না, কিন্তু ছেলেটা বেশ অন্যরকম ছিল, একটা আত্মসম্মান-ওয়ালা ছেলে, জীবন যুদ্ধে সোজা হয়ে লড়ে যাওয়া একটা ছেলে।

প্রায়ই আসতো, গল্প করে যেত, আর কিছু চানাচুর রেখে যেত।

বেশ ভাল লাগত, ছেলেটা এলে, গতানুগতিক জীবনের বাইরে একটা অন্যরকম হাওয়া।

তারপর, একদিন হঠাত খেয়াল হল একদিন, ছেলেটা অনেকদিন যেন আসেনি।

ঠাম্মা জিগ্যেস করল, ২ সপ্তাহ আগে এল – তাই না রে কাজল?

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, বললাম, হ্যাঁ, ওইরকমই হবে।

আমরা ভাবতাম, এই হয়েত আসবে, হয়েত ফুটবল খেলার সুযোগটা পেয়েছে, আসবে কয়েকদিন পরে।

অপেক্ষা করতাম।

কিন্তু, সে আর আসেনি।

নামটা তখন জানতাম, কিন্তু – আজ আর মনে নেই।

অথবা, উত্তরপাড়া লাইব্রেরীর মাঠে যখন বিকেলে খেলা হত, একটা ছোট্ট ছেলে, ১০-১২ বছর বয়েস হবে, লাইব্রেরীর সিড়িতে বসে আমাদের খেলা দেখত, গালে হাত দিয়ে।

একদিন, খেলার পরে, গিয়ে বসলাম ছেলেটার পাশে।

অন্ধকার হয়ে আসছিল, মাথার উপর কিছু মশা ঘুরে বেড়াচ্ছিল, রোজকার মতন।

হাতের ক্যাম্বিস বলটা ছেলেটাকে দিলাম।

একগাল হেসে নিল।

জিগ্যেস করলাম – বসে থাকো যে এখানে, খেলবে কাল থেকে আমাদের সঙ্গে?

মুখটা হাসিতে ভরে উঠল, বলল – “হ্যাঁ, খেলব, তবে...বাবা বলেছে, যে অসুখ সেরে গেলে তারপর খেলতে”।
 

আমি বললাম, বেশ তো, তাই নাহয় হবে।

কিন্তু বললে না তো – তোমার কি হয়েছে...

ছোট ছেলে তো – প্রশ্নটা শুনে একটু সামস্যায়ে পড়ে গেল বোধহয়।

মাথার টুপিটা খুলে কয়েকবার মাথাটা চুলকে নিল। 

আর আমি খানিক্ষন অর চুলবিহীন ছোট্ট ন্যাড়া মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

খানিক্ষণ পরে জিগ্যেস করলাম – তোমার নাম কি?
 
বলেছিল, কিন্তু আজ আর মনে নেই।

 

আমরা আসলে অনেক কিছু ভুলে যাই, জীবনের স্রোতে অনেক কিছু ভেসে যায়, এটা বোধহয় স্বাভাবিক, কিম্বা নয় – বলতে পারবো না ঠিক।

ছেলেরা যেমন, বিয়ের পরে বিয়ের দিন ভুলে যায় (কেস তারপর কি খায়ে মোটামুটি সবারই জানা আছে, খোলসা করছি না আর এখানে), বউ-র জন্মদিনও মাঝে মাঝে ভোলে (সেম রেজাল্ট), অফিসে বস-র দেওয়া কাজ করতে ভুলে যায় (পাশের মেয়েটার “একটু করে দাও না এটা” বলে দেওয়া কাজটা কিন্তু ভোলে না – কি করা যাবে, ইনসেনটিভ চাই তো নাকি!!), আবার অফিস থেকে বেরিয়ে পাব-এ ঢুকে তারপর বাড়ী ফেরার রাস্তাটা ভুলে যায়।

মেয়েরা যদিও কিছুই ভোলে না, এবং সেটাই সবথেকে বড় সমস্যা। এর জ্বালায়ে ছেলেদের নিজের নাম ভুলে যাবার জোগাড় প্রায়।

 
তবে, এই ভুলে যাওয়াগুলো বেশ মজার, একদিক থেকে দেখতে গেলে।

কারণ, পরে, মনে পড়লে, আমরা নিজেরাই হাসি, এই ভুলে যাওয়া আর তার পরিণাম মনে করে।
 

কিন্তু, কখনও কখনও স্বপ্ন ঘিরে ধরে, আবছা ধোঁয়াশা, যেন একটা মশারীর মধ্যে দিয়ে দেখা – সেই দৃশ্যগুলো, কিছুতেই যেন মনে পড়তে চায় না, ধরা দিয়েও ধরা পড়েনা – সেই ভুলে যাওয়াগুলো, মজা দেয় কি? হয়েত না, জানি না।

 

আস্তে আস্তে বিস্মৃত হওয়া নাম, ঘটনা, দিন, বন্ধু, সময় – সব ভেসে যায় – হয়েত পরে কোনদিন মনে পড়বে যেটা চাই মনে করতে, পাড়ে এসে ঠেকবে স্মৃতিগুলো, কিন্তু তখন হয়েত অনেক দেরী হয়ে যাবে।

 

নাহ, দেখেছেন তো, নামগুলো কিছুতেই আর মনে পড়ল না!!

তবে মনে পড়লে, অবশ্যই আপনাদের জানাবো।

3 comments:

  1. এই লেখাটায় খুব আলগা করে বলা কিছু কঠিন সত্যি রয়েছে। কিন্তু সেই তেতো কঠিন সত্যি গুলো তোমার কলমের জোরে মুখে হাসি টেনে আনতে পারছে। তেতো সত্য নিয়ে রসিকতা করা সোজা নয়, কিন্তু তুমি সেটা অনায়াসে করেছ। সাব্বাস।

    ReplyDelete
  2. এই লেখাটায় খুব আলগা করে বলা কিছু কঠিন সত্যি রয়েছে। কিন্তু সেই তেতো কঠিন সত্যি গুলো তোমার কলমের জোরে মুখে হাসি টেনে আনতে পারছে। তেতো সত্য নিয়ে রসিকতা করা সোজা নয়, কিন্তু তুমি সেটা অনায়াসে করেছ। সাব্বাস।

    ReplyDelete