গোল, খসখসে, খয়েরি রঙের থালা। উপরে একটা গোল করে কাটা কলাপাতা – সবুজ, লম্বা লম্বা হালকা দাগ তাতে। তার উপর একটু সাদা দানা দানা গুঁড়ো – একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আর একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি সবুজ-হলুদ ফালি।
ব্যাস, যথেষ্ট।
আতান্তরে পড়লেন তো? ভাবছেন – ভাট বকছে এ ছোকরা!
না, ঠিক সেরকমটি নয় এক্ষেত্রে - ব্যতিক্রম বলতে পারেন।
আচ্ছা, খোলসা করি।
বেশী নয়, হালকা করে বছর ১৫-১৮ পিছিয়ে যান। আরে, স্মৃতির সরনী বেয়ে।
হ্যাঁ – গ্যাছেন?
বাহ, বেশ।
এবার ভাবুন, ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরম, স্কুলে সবে ছুটি পড়েছে, সন্ধ্যে হলেই বাড়িতে তিষ্ঠোবার যো নেই – মশার কামড়ে, বাইরে দিনরাত নির্বিশেষে কুকুরদের জৈবিক চিৎকার – ঠিক এইরকম সময়ে আপনার পাড়ার বছর বত্রিশের টুকুন দির বিয়ে লাগল। পাড়াশুদ্ধু ঝেঁটিয়ে নেমন্তন্ন। আপনি সন্ধ্যে থেকে টেরিলিনের জামাটা ইস্তিরি করে রেখেছেন, আর সুতির ফুলপ্যান্টুলটা জল মেরে চেষ্টা করেও আদ্ধেক ভাঁজ সোজা করতে পারেননি। সন্ধ্যে ৬ টা থেকে পাক্কা চল্লিশ মিনিট টেরি বাগাবার চেষ্টা করেও মাথার মাঝের খাড়া হয়ে থাকা একগোছা চুলকে পাট করতে ব্যর্থ হয়েছেন, আর তার জন্যে নিজের প্রায় কদমফুলের মত করে কাটা চুলের গুষ্ঠির পিন্ডি উদ্ধার করেছেন। শেষে, বাইরে থেকে গজা, ভুঁদু, লুচি আর রাজুর ক্রমাগত গালাগালি সহ্য করতে না পেরে “নিকুচি করেছে” বলে বেরিয়ে এসেছেন।
প্রায় ৭ টা বাজে-বাজে দেখে চার বন্ধুতে গিয়ে সেঁধিয়েছেন বিয়েবাড়ির ভেতরে। উপহার দেবার হ্যাপা নেই, কারণ সেটি বাড়ির বড়দের দায়ীত্ব, আপনি ঝাড়া হাত-পা। একটু চারিদিকে দেখেশুনে, অত্যন্ত সাজগোজ করা রুপসী অপ্সরাদের তাচ্ছিল্যভরা চাহনির সামনে অত্যন্ত বিব্রত বোধ করে যেই না একটু বাইরে বেরিয়ে এসে হাবুল-দের রকে বসে একটু পেপসি খাবেন বলে ভাবছিলেন চার বন্ধু, অমনি বিপদ।
“এই যে, তোমরা – এসো এসো, খেতে বসে যাও, খেতে বসে যাও, ব্যাচ ফাঁকা যাচ্ছে যে” – টুকুন দির বড্ড-বাজে-বকা জ্যেঠু দেখে ফেলেছেন। মহা চিত্তির। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময়ে কোন বাঙালী রাতের খাবার খায়!! এখন তো খিদেটাই জমে নি। খেতে বসলে তো ফুল লস!! কেটে পড়বার ধান্দা খুঁজতে খুঁজতেই আবার তাগিদ – এবং প্রায় জোর করেই খেদিয়ে দেওয়া খাবার জায়গার দিকে।
একে তো ভ্যাপসা গরম, তায় আবার খাবার জায়গায় দুটিমাত্র পাখা চলছে – যদিও সেই পাখার সাইজ দৈত্যাকার – কারুর ওজন ৩৫ কেজির কম হলে তাকে হাত ধরে পাখার সামনে দিয়ে পার করানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ, নইলে উড়ে গিয়ে কারুর কোলে গিয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। এদিকে আপনি তো টেরিলিনের বাহারি জামার মধ্যে কুলকুল করে ঘামতে শুরু করে দিয়েছেন অনেক্ষণ আগে থেকেই, আর সেই ঘাম গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ আকর্ষণে – নিচের দিকে। আপনার বেশ আসোয়াস্তিসূচক একটা সুড়সুড়ি অনুভব হচ্ছে তাতে, কিন্তু আপনি না পারছেন তাতে হাসতে, না পারছেন একটু চুলকে নিতে। এমতবস্থায়, অত্যন্ত অস্বস্তি সহকারে আপনি বসলেন কোনের টেবিলে – যেটি পাখা থেকে সবথেকে দূরে। বাকি সবাই আগে এসে পাখার অবস্থান বুঝে জায়গা করে নিয়েছেন, আর আপনারা চার বাঞ্ছারাম, “খালি ব্যাচ” ভর্তি করতে গিয়ে কোনের টেবিলটাই পেয়েছেন। আপনার বন্ধু, ভুঁদু, একটু মোটা, এই ৯৮ কিলো মত, আর বেশ ঘামে। আপনি দেখলেন যে সে টেবিলে হাত রেখে বেশ বিদ্ধস্ত অবস্থায় একটি মিনি-গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে। তারপর যখন সে হাতটি টেবিল থেকে সরালো, দুই কনুইতে জামার হাতায় বেশ বড় বড় দুটো কালো ছোপ আপনি দেখতে পেলেন। এরপর নিজের কনুইয়ের দিকে তাকাবার সাহস আপনার হয়নি।
এত বড় একটা ঘর্মাক্ত বিবরণ দেবার কারণ আশা করি বুঝতে পারছেন! এই অসহ্য অবস্থায় আপনারা কেউ কোনদিন পড়েননি বললে আমি মানবো না।
কিন্তু, এই ভয়ানক বিরক্তিকর ব্যাপারগুলোর পরেই হয় সেই ব্যাপারটা।
বুঝলেন না?! ওই যে, গোল গোল, খসখসে, খয়েরী রঙের থালা!
দুটো “A” আকৃতির ডান্ডার উপর অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে দাঁড় করানো একটা বহু-ব্যবহারে দাগ ধরা প্লাইউডের তক্তার (পড়ুন টেবিলের) উপর এসে যখন ওই বস্তুটি পড়ত, এতক্ষণের সমস্ত গা-কুটকুটে বিরক্তি এক ঝটকায় উড়ে যেত। এতক্ষণের যত ঘাম আপনার টেরিলিনের জামা শুষেছে, আপনার মনে হত এবার দে হতচ্ছাড়া, দেখ এবার আমি কত শুষি আমার পেটে!
কিন্তু সেটাই আসল ব্যাপার নয়।
মনে করে দেখুন – সুন্দর পাতা পাতা গন্ধ ওঠা থালা পেয়েছেন, সোঁদা গন্ধওলা মাটির ভাঁড়ে জল পেয়েছেন, সাদা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতও পড়েছে পাতে, ডাল, মাছের পেটি, পাঁঠার মাংসের গোটা নলিটাও আপনিই পেয়েছেন – তাও আপনি অনেক্ষন থেকে রাগতভাবে খোঁজেননি পরিবেশক ছেলেটিকে, আর তাকে বলেননি – “দাদা, নুন আর লেবুটা দেননি – দিন!!”?
এইরকম কিছু জিনিস থাকে আমাদের সবারই – যেগুলোর জন্যেই বাঙলা অভিধানে ওই “অপরিহার্য” কথাটি ঢুকেছিল।
আমার কাছে সেইরকম একটা জিনিস হল - পাঁপড়।
ছোট থেকেই, খাবার ব্যাপারে আমি বেয়াড়া। এটা খাবো না, সেটা খাবো না তো ছিলই, তার উপর ওই শাক-কুমড়ো-লাউ-বেগুন-মুলো আমি খেতুম না। তবে হ্যাঁ, তাবলে এরকমও ছিল না যে মাছ-মাংস ছাড়া আমার মুখে রুচত না। এই এট্টু গরম ভাতের সাথে ঘি, আর ডাল হলেই আমার চলে যেত।
আর এই সাধারণ খাবারটাই একটা অসাধারণ মাত্রা পেত যদি সঙ্গে থাকত কিছু পাঁপড়।
আমাকে পাঁপড় বিশারদ বললে অত্যুক্তি হবে না। পাতি ডালের পাঁপড় দিয়ে আমার এই পাঁপড়ভক্তির শুরু – তখন ছিল সেই “লিজ্জত” পাঁপড়। তারপর আস্তে আস্তে মশলা পাঁপড়, চালের পাঁপড়, সাবুর পাঁপড় থেকে উত্তরণ ঘটতে ঘটতে চিংড়ির পাঁপড় অবধি পৌঁছেছিলাম খুব অল্প সময়তেই। তবে হ্যাঁ, আমার কিন্তু ওই “স্বাস্থ্যকর” সেঁকা পাঁপড়ের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। একটু তেলে চুবিয়ে ভাজা হবে, সেই তেলগুলো একটু গড়িয়ে পাত্তরের তলায় যদি লেগে নাই থাকল, তাহলে আর পাঁপড় খাবার মানে কি!! ওসব সেঁকা-টেকা খাবে ওইসব সিড়িঙ্গে মেয়েরা, আমি কেন! ছোঃ!
আর এই করতে করতে আমার পাঁপড়প্রেম এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে আমাকে অনেকে এরকম ঠাট্টাও করেছেন যে আমি নাকি জল খেতে গেলেও পাঁপড় দিয়ে খাই! এবং অনেক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল, যেখানে আমি কোনদিন বেড়াতে গেলে, তারা আমার জন্যে আলাদা করে পাঁপড় আনতেন দোকান থেকে। কি বিড়ম্বনা বলুন দেখি!!
তবে কেন জানি না, এই সাবুর পাঁপড়ের প্রতি আমার একটা আলাদা নির্লজ্জ আকর্ষণ আছে। আহা, বড্ড ভালো খেতে। ভাত-ডালের সঙ্গে খাও, মাছের সঙ্গে খাও, মাংসের সঙ্গে খাও, ডিমের ঝোলের সঙ্গে খাও, বিকেলে খিদে পেলে শুধু শুধু খাও, এমনকি একটু ইয়ের সঙ্গে কিছু টিয়ে না থাকলে সাবুর পাঁপড় দিয়ে খাও – সর্বঘটের কাঁঠালী কলা নয়!!
আসলে, এত কথা বলে ফেললুম কারণ, আজ সন্ধ্যেবেলা সাবুর পাঁপড়ের শেষ ভাজা টুকরোটা খেতে খেতে ভাবছিলাম যে যদি সাবুর পাঁপড় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় এখন, তাহলে আমার কি হবে!! বেশ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম এই ভেবে। এরকম একটা অপরিহার্য বস্তু বিদায় নিলে কি বিষম বিপদ বলুন দেখি!
অদ্রীশ বর্ধনের গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র, সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে হুস করে বেরিয়ে যাওয়া সোনালি বিকেল, গঙ্গার পাড়ে ভাটার সময়ে পড়ে থাকা পলিতে মাছের অপেক্ষায় বসে থাকা সাদা বক, সন্ধ্যের মুখে হালকা আলোয় সাইকেলে করে চলে যাওয়া কিশোর-কিশোরী, ফুটবল খেলার শেষে মাঠের ধারে বটগাছের নিচে বসে আড্ডা, স্কুলের পরে টিউশনের ব্যাচে চোখাচোখি আর ভেঙে যাওয়া প্রেম, বাপ-মা-দাদা-দিদি দিয়ে ঘিরে থাকা পরিবার, বনধের দিনে বড় রাস্তা জুড়ে পাড়ার বড় থেকে বাচ্চা – সবার ক্রিকেট খেলা, মায় বাঙলার গর্ব প্রোফেসর শঙ্কু – এ সবই তো একদিন অপরিহার্যই ছিল।
পাঁপড়ও নাহয় সেরকমই একদিন...
নাঃ, কাল শঙ্করের মুদির দোকানের লিস্টিতে পাঁপড়টা যোগ করে নিতে হবে।
আর নয়ত... “এই নমিতাআআআ, যা তো বাবা একটু সামনের মুদির দোকানটায়, এক প্যাকেট সাবুর পাঁপড় এনে দে, তারপর এসে ঘরটা মুছিস আবার!”
বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। যে সলতেটায় আগুন ধরানো হয়েছে, সে সলতেটা মামুলি চিনেপটকার নয়, দস্তুরমত বড়সড় হাউইয়ের। শালপাতার থালা, মাটির গেলাস, কাঠের তক্তাপাতা টেবিল, গরমে ঘুরতে থাকা দৈত্যাকৃতি পেডেস্টাল পাখা সব কিছু কেমন অবলীলায় নেমে এলো। তার পরে দেখলুম সেসব আদতে নাটকের মঞ্চের পেছনে সাজানো দৃশ্যপট। একটু দেরি করে নটসম্রাট মঞ্চে এলেন। পাঁপড়। কিন্তু পাঁপড়ই নয় কেবল। তার তার ধরে এল ইন্দ্রনাথ রুদ্র, সোনালী বিকেল, সাইকেলে কিশোর কিশোরী, সাদা বক, টিউশন, প্রেম, বাবা মা। সঞ্জীব চাটুয্যে হতে পারো হে নীলাঞ্জন। তেনার লেখায় এগুলো আসত এই ভাবেই। একটু একটু করে মায়া মায়া লেখায় জড়িয়ে নেওয়া। অপূর্ব সুন্দর এ লেখা। সকাল বেলায় পড়ে মনটা অদ্ভুত ভাল হয়ে গেল। তুখোড়।
ReplyDeleteসিধু জ্যাঠার ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে - " দেখি তোমার আঙুল গুলো....... জিতে রহো বাচ্চে"।
চোখটা একটু ভিজে গেল যে!! কি যে বলি! আমি সঞ্জীব চাটুয্যে নই, কিন্তু পড়ে যে ভালো লেগেছে, আর তেনার কথা মনে হয়েছে - এই দুটোর থেকে বড় পাওনা আর কি হতে পারে।
ReplyDeleteআরেকটা ব্যাপার দেখে দারুণ খুশি হলাম। আমি ঠিক যে যে ভাবনা নিয়ে লিখেছি, তুমি ঠিক সেই সেইগুলো পড়েছ। এটাও বোধহয় লেখার সার্থকতা।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteকি করেছে ছেলেটা! এটা তো ভীষন একটা লেখা হয়েছে!!!
ReplyDeleteহে হে, ধন্যবাদ ম্যাডাম :)
DeleteSundor.. Besh onno rokomer ekta lekha.. Pore valo laglo.
ReplyDeleteধন্যবাদ ভাই। তবে আমার নিজের তো আমার সব লেখাই এক লাগে।
Deleteবেড়ে হয়েছে কিন্তু লেখাটা। পড়ে ব্যাপক লাগলো। আর আমি সোমনাথ দার সাথে একমত, সত্যিই তোর লেখার সাথে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখার মিল আছে, দুটোই একই রকম free flowing আর easy to read. পড়ে মনে হয় কোনো conversation শুনছি । চালিয়ে যা।
ReplyDeleteধন্যবাদ ভাইটু, ধন্যবাদ। :) একটু বৈঠকি ভাব রাখার চেষ্টা করি বটে।
Deleteআর প্রুফ কারেকশনের জন্যেও ধন্যবাদ। হে হে।
সাবুর পাঁপড় আমিও বড্ড ভালোবাসি, তার সাথে ইন্দ্রনাথ রুদ্র, সোনালী বিকেল, সাইকেল, কিশোর-কিশোরী, টিউশন ...... সেই লম্বা কাঠের টেবিল , ভাঁজ করা চেয়ার, শালপাতা, মাটির ভাঁড়, নুন লেবু এইসব নষ্টালজিক বস্তুগুলো এখনও স্বপ্নে দেখি....... এই লেখাটা পড়ার পর আজ রাতে ঘুমের মাঝে এদের দর্শন পাব মনে হচ্ছে ..... মনভরে গেল ভাই ... লেখাতো নয় যেন তেল চপচপে নষ্টালজিক পাঁপড় ...... পাঁপড়ের সাথে ভোজ বাড়িতে হারিয়ে যাওয়া আরো একটা বস্তুর কথা মনে পড়ল .... দুফালি করে কাটা বোঁটা সমেত লম্বা বেগুন ভাজা .....
ReplyDeleteযা বলেছ সুদীপ্ত দা, সেই জিনিসটাও আজ বড় দুর্লভ। আজকালকার ক্যাটারার আর ব্যুফের দিনে, সেই সময়কার জামার হাতা গুটিয়ে বাড়ীর আর পাড়ার ছেলেদের পরিবেশন করতে নেমে পড়াটাও কি মিস করি না?!
DeleteThis comment has been removed by the author.
DeleteJust ফাটাফাটি লিখেছ ..দারুন অপূর্ব লেখা ..আরো চাই
ReplyDeleteবলছিস? :) এরকম বললে তো লিখতেই হয়!! :) পুজোর সময় একটা লেখার প্ল্যান আছে।
DeleteSabur papor tomak dekhiye dekghiye khabo
ReplyDelete....
R likhcho na kano kichu?
লিখবো রে পাগলা! 😊😄
Delete