Saturday, February 6, 2016

ল্যাজ

আজ পর্যন্ত সবথেকে বড় সেলিব্রিটি ল্যাজ হচ্ছে পবনপুত্র হনুমানের।

গপ্পোটা আপনারা সবাই জানেন, সেই লঙ্কাকান্ডের ব্যাপারটা। ভেবে দেখুন – একটা গোটা রাজত্বের বেশ একটা বড় অংশের সত্যানাশ করে দিয়ে এসেছিলেন ভদ্রলোক! থুড়ি, ভদ্রহনু!

ভেবে দেখবেন, ব্যাপারটা মোটেই হেলাছেদ্দা করার মত নয়। আগুন লাগাতে হত – হাতে করে মশাল নিয়ে যাওয়া যেত! চাইলে ওই ফোলা গালের মধ্যে করে একটা বড় সাইজের সুতলি বোমা নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু না, তিনি কি করলেন?! ল্যাজে করে আগুন লাগালেন!!

প্রভুভক্তি দেখানোর আর রাস্তা ছিল না!!

সাধে কি লোকে বলে, ওই যে দিদির ল্যাজ মদনা যাচ্ছে!!

তবে, আপনাদের কোন ধারণা আছে যে এই ল্যাজ কি বিষম দরকারি বস্তু?
বলছি শুনুন।

প্রাণীজগতে, এই ল্যাজ একটি অত্যন্ত দরকারি অঙ্গ। কখনো কাঠবেড়ালিকে ছুটতে দেখেছেন? বা গাছে উঠতে-নামতে? বা কোনো বাঁদরকে এবাড়ি থেকে ওবাড়ির ছাদে লাফিয়ে যেতে?
লক্ষ্য করবেন, এদের ল্যাজগুলো এই সময়ে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদিক-ওদিক নড়তে থাকে ক্রমাগত। আসলে, এই ল্যাজ হচ্ছে ওদের ব্যালেন্স রাখার মূল অঙ্গ।

শুধু তাই নয়। আপনার পাশের বাড়ির সদ্য কলেজ পাশ করা মটকা-ঝটকা দিয়ে অযথা এঁকেবেঁকে চলা মামনির পোষা ভোলা যখন আপনাকে দেখে ল্যাজ নাড়ে, আপনি বোঝেন যে তার খুব আনন্দ হয়েছে। আর আপনি ভোলার সেই আনন্দের ছুতো করে একটু হাবিজাবি বকে নেন!!
ভেবে দেখুন তো, যদি ভোলার মালকিনেরও একটা ল্যাজ থাকত, তাহলে কত সহজেই না আপনি বুঝতে পারতেন যে সেও আপনাকে দেখে আনন্দ পেয়েছে কিনা! নাহলে, একজন মেয়ের মুখ দেখে বুঝবেন, এত বড় শর্মা তো আপনি নন!!

এখন মানবেন তো ল্যাজের উপকারিতা?

তবে এই হুনুমানের ল্যাজ কিন্তু ছোটবেলায় আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন টিভি তে রামায়ণ সিরিয়াল দেখাতো, আর আমি বেশ মন দিয়েই দেখতাম। আর সেইসব উচ্চমার্গের যুদ্ধবিগ্রহ দেখার পর আমার সেগুলো নকল করার বেশ একটা অদম্য ইচ্ছা হত।
বেত বেঁকিয়ে ধনুক বানানো, বা পাটকাঠি দিয়ে তীর, এইসব আমি করেছিলাম বটে। এমনকি মহাভারতের ভীমের গদাও আমার কাছে সুপারহিট হয়েছিল।

তবে যেটা সবথেকে বেশী এখনও যেটা মনে আছে, সেটা হল হনুমানের ল্যাজ!
মূলধন তো সেরকম কিছু ছিল না সেই সময়ে। তা একদিন হনুমানের লঙ্কাকান্ডের জ্বালাময়ী এপিসোড দেখার পর পাড়ার মাঠে বেরিয়েছি রোমাঞ্চকর ব্যাপারটাকে একটা বাস্তব রূপ দেবার ইচ্ছায়। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছি মাঠে, আর ভাবছি যে একটা ওরকম আকর্ষণীয় ল্যাজ তো বানাতেই হয়! এরকম ভাবতে ভাবতেই – ইউরেকা!! পেয়ে গেলাম। মাঠে একটি পেঁপেগাছ থেকে ঝুলছে একটি প্রায়-শুকনো ডাল।

দেখেছেন কি পেঁপেগাছের শুকনো ডাল? বলে দি বরং।

যে দিকটা গাছে লেগে থাকে, সে অংশটা একটু মোটা হয়। তারপর একটু হালকা করে বেঁকে ডালটা নেমে আসে নিচের দিকে। আর শেষে আরেকটা হালকা উপর দিকে বাঁক মেরে শেষ হয় বেশ একটা ঝুপসো পাতায়। পাতাটা অনেকটা ওই তাসের চিড়িতনের মত দেখতে, শুধু ধারগুলো একটু কোনাচে হয়।

নিলাম পেড়ে। ডালটা। হাতটা পেছনদিকে বেঁকিয়ে দিলুম গুঁজে পিছন দিকে প্যান্টুলুনের উপর দিকে। আপনারা ঠিক ব্যাপারটা কল্পনা করতে পারছেন কিনা জানিনা, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আসল হনুমানেরও এত ভালো ল্যাজ ছিল না!!

গন্ডগোলটা হল তার পরে। ডালটা যে গাছে ছিল, আর গাছে যে পিঁপড়ে ছিল সেটা আমি ঠিক তখন ভেবে উঠতে পারিনি উত্তেজনার বশে!! তারপর, কি আর বলব – লঙ্কাকান্ড লঙ্কাকান্ড!!!!!

এমন একটা জিনিস নিয়ে লিখতে বসলাম যা কিনা আমাদেরই নেই!! মোটামুটি মানুষ ছাড়া, প্রাণীজগতের আর বাকি সবারই ল্যাজ আছে। বিভিন্ন আকার এবং প্রকারের – তবে আছে। মোটা, সরু, ছোট, বড়, লোমশ, টিংটিঙে – সব পাবেন।

আমাদেরও নাকি শরীরে এমন একপিস হাড় আছে যেটা এককালে নাকি ল্যাজের অংশ ছিল। মেরুদন্ডের একদম শেষের হাড়, নাম হচ্ছে কসিক্স (coccyx), যেটি ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে এখন শুধুই একটি হাড়।

দেখুন দিকি, আমাদের লাফালাফি তো কমেনি, বরং বেড়েইছে, তবু আমাদের ল্যাজ লোপ পেয়েছে!! আর সেইজন্যেই বোধহয়, আমাদের ব্যালেন্সটা ক্রমাগত হড়কে যাচ্ছে দিনকে দিন!!

আবার, এই ল্যাজ নিয়ে কিছু প্রবাদ বাক্যও চালু আছে। যেমন ধরুন সাপের ল্যাজে পা দেওয়া! আমি যদিও বেশ আতান্তরে পড়ি সাপের ঠিক কোনটা ল্যাজ সেটা খুঁজে বার করতে, তবে মোটামুটি ওই লিকলিকে পুরোটাই ল্যাজ ধরে নিয়ে দূরে থাকাটাই আমার চিরকাল শ্রেয় মনে হয়েছে!

তবে একবার আদর করে বাড়ির সবথেকে শান্ত মেনি বেড়ালটার ল্যাজ টেনে দিয়েছিলুম। উরেব্বাপ!!! এমন ফ্যাঁস করেছিল যে আমার তো প্রায় টাকে উঠে ঘোরার যোগাড় হয়েছিল!!

তারপর অনেকদিন সেই অপোগন্ডটাকে খুঁজেছিলাম যে শালা বলেছিল যে শুধু সাপের ল্যাজেই পা দিলে নাকি...

তা, কয়েকদিন ধরেই এইসব ভয়ানক ভাবনাচিন্তা করতে করতে মনে হল যদি আমাদের একটি করে ল্যাজ থাকত, তাহলে কি কি সুবিধা বা অসুবিধা হত!!

ধরুন, আপনি আজ কাজে একটা দারুণ প্রশংসা পেয়েছেন আপনার বসের কাছে। সবার সামনে বেশ পিঠ চাপড়ানি-টানি খেয়ে আপনি নিজের জায়গায় ফিরলেন। মেজাজ ফুরফুরে। হালকা করে ল্যাজটা এদিক-ওদিক দোলাতে থাকুন – দেখবেন মেজাজটাই পুরো সিংহ রাজের মত হয়ে যাবে!!

আবার ধরুন, সেই রাতেই, আনন্দের চোটে আপনি অফিস থেকে বেরিয়ে এট্টু পানভোজন করে রাত করে বাড়ি ঢুকলেন। এবং ঢুকে বুঝলেন যে আপনি ফেরার পথে বাজার করে আনতে ভুলে গেছেন, যেটা সকালেই আপনাকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল।
কি করবেন? খুব সহজ – ল্যাজটা একটু নেতিয়ে নিয়ে নিজের চারপাশে হালকা গোল করে পেঁচিয়ে নিয়ে বসে থাকুন, দেখবেন ঝাড়টা একটু হলেও কম পড়বে। হাজার হোক – সহানুভুতি বলেও তো কিছু জিনিস আছে!!

ওই সেই “অবতার” সিনেমা তে দেখিয়েছিল না, যে কিরকম সব ল্যাজে-ল্যাজে বেশ মেলামেলি হচ্ছে, আর কিসব বন্ধন তৈরি হচ্ছে!!

ধরুন আপনি বসে আছেন, কোনো জনবহুল জায়গায়। পাশে আপনার প্রেমিকা। খুব হাত-টাত ধরতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সবার সামনে ঠিক পারছেন না। হালকা করে ল্যাজটা একটু এগিয়ে নিয়ে যান, টুক করে গিয়ে প্রেমিকার ল্যাজে টুক করে জড়িয়ে নিন – ব্যাস, সমস্যার গদগদ সমাধান!!

প্রেমিকা রাগ করে হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে?! কুছ পরোয়া নেহি, তার হাত আপনার হাতের বাইরে গেলেও, ল্যাজ তো আপনার হাতের নাগালেই আছে, নাকি!! হাঁ করে দেখছেন কি?? ধরুন চেপে!!
তবে হ্যাঁ, খুব জোরে চাপবেন না – ওই ল্যাজে পা পড়ার প্রবাদটা একটু মনে রাখবেন কিন্তু!!

আবার কিছু মুশকিলও আছে।

দলে বসে আড্ডা মারছেন বন্ধুবান্ধব মিলে, ইচ্ছে হল একটু বান্ধবীর সঙ্গে খুনসুটি করবেন। চুপি চুপি ল্যাজ দিয়ে তার ল্যাজে বোলাতে লাগলেন। বেশ খানিক পরে কোনো সাড়া না পেয়ে যখন তাকালেন, দেখলেন যে তার পাশের সুর্পনখা টাইপের মেয়েটি বেশ লাজুক হাসছে আপনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে!! করলেন তো রং নাম্বার!!!

সবথেকে বড় মুশকিল অবশ্য অন্য জায়গায়! চোখের উপর কি লাগাবো, লিপস্টিক কি রঙের হবে, চুল সোজা থাকবে নাকি খোঁপা, কানে কটা দুল পরব, জামার রঙ কিসের সাথে মানাবে, জুতো কি হাই-হিল নাকি প্ল্যাটফর্ম – এই মহাভারতেই তো পৃথিবীর অর্ধেক সমস্যা আটকে আছে!! তারপর যদি আবার ল্যাজ যোগ হয়!!! সেই ল্যাজের পরিচর্যা, ওয়্যাক্সিং, রুপচর্চা – ভাবলেই আতঙ্ক লাগছে না কি!!

আর এরপর বাকি রইল প্রেম-বিবাহ সম্পর্কিত বিপদ!!

প্রেমিকা প্রেমিককে পরিত্যাগ করল। কারণ?
কলেজের আরেকটি মেয়ে কথা বলতে বলতে ছেলেটির ল্যাজে একটু হাত বুলিয়েছিল!! কাঁহাতক সহ্য করা যায়!! সত্যিই তো!!

বা ধরুন, কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপন বেরোল – পাত্র সবর্ন ব্রাহ্মণ, উচ্চতা ৫’১”, সরকারি চাকুরিরত, একমাত্র সন্তান, ফর্সা, একটি পুরুষালি ল্যাজের গর্বিত অধিকারী। বিবাহপোযোগী সুপাত্রীরা যোগাযোগ করুন। ল্যাজহীন কন্যারা মাফ করবেন।

অথবা – পাত্রী স্নাতক, গৃহরতা, সঙ্গীতশিল্পে এবং রন্ধনশিল্পে পটিয়সী (দুই হাত এবং ল্যাজের সাহায্যে নিপুণভাবে এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিভিন্ন পদ রাঁধিতে সক্ষম – পরীক্ষা প্রার্থনীয়)!!

শাশুড়িরাও আর একটি অস্ত্র পাবেন তাদের বৌমাদের পেছনে লাগতে।
“বৌমা – তুমি সেই আবার ল্যাজ না ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছ!!”
অথবা...
“বৌমা – তুমি জানো না আজ বাড়িতে নিরামিষ, আর তুমি ল্যাজে করে থালাটা মুছলে!!”

কি বিতিকিচ্ছিরি কান্ড দেখুন তো!! ল্যাজ থাকলেও তো বিপদ!!

এক কাজ করুন না, চলুন না বরং আবার ফিরে যাওয়া যাক সেই বিবর্তনের পথে - তবে এবার পেছন দিকে। হয়ত ল্যাজ ফিরে আসবে, আর তার সঙ্গে কিছু বোধবুদ্ধি!

সবসময় পিছনে ফিরে যাওয়া মানে কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া নয়!

9 comments:

  1. Darun lekha.. Lej thakle poritriptite hoitoh ektu nore uthto

    ReplyDelete
  2. হা হা হা হা 😂😂

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. ল্যাজ নিয়ে এরকম লেখা আমি আগে পড়িনি। সব চেয়ে ভালো লাগল ওই প্রেম করার সময় ল্যাজের ব্যবহার। উফফ। এটা ফাটাফাটি। সত্যি যদি এরকম হতো। কি ভাল হতো। এখন পড়ে মনে হচ্ছে। লেজ থাকলে প্রেমের মাধুর্য্য, লুকিয়ে আচার খাওয়ার মত আর একটু বেড়ে যেত।

    সব মিলিয়ে খাশা একখানা রম্য রচনা। পড়লেই মন ভাল হয়ে যেতে বাধ্য। অনেক দিন পর প্রান খুলে হাসলাম। আর হাসার পরেও প্রেমের ল্যাজ ধরে একটা রেশ রয়ে গেল। সাব্বাস।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সুকুমার রায়ের হুঁকোমুখো হ্যাংলার মত এটাও দুটো ল্যাজের যেকোন দিকে যেতে পারত। শেষ পর্যন্ত যে কৌতুকের রাস্তায় গেছে, আর তোমার ভালো লেগেছে, এটা বড় ব্যাপার! হে হে, লিখতে লিখতে আমিও একটু হেসেছি বটে!

      Delete
  5. এত পরিপাটি রম্য রচনা আমাদের ল্যাজের মতোই লুপ্তপ্রায় .... দারুণ লাগলো ......

    ReplyDelete
    Replies
    1. হুকোমুখো হ্যাংলার দুটো ছিল, তাও গোমড়া ছিল সে। আমাদের একটাও নেই, বুঝতেই পারছ আমরা কি পরিমাণ গোমড়া!! তাই একটু ল্যাজের আধিক্যে হাসাবার প্রচেষ্টা আরকি!!

      Delete