Saturday, May 14, 2016

উল্টোপাল্টা


শ্যামবাজারউত্তর কলকাতাবুধবার

প্রতিদিন ঘড়ি ধরে ভোর পাঁচটায় উঠে বস্তির সামনের টিউবওয়েলটা থেকে দুবালতি জল ভরেসেটা দিয়ে আধঘন্টা ধরে চান করাটা নিধুখুড়োর আজন্মকালের অভ্যেস!

আর সেই চানপর্বের জলের ঝপাস ঝপাস আওয়াজআর সঙ্গে খুড়োর উচ্চস্বরে গাওয়া বেসুরো শ্যামাসঙ্গীতের সমস্বর কোলাহলে রোজই অখিলের ভোরের সুখের ঘুমটার বারোটা বাজে!

যদিও ঘড়ি ধরে” কথাটা আক্ষরিক অর্থে ঠিক নয়কারণ নিধুখুড়ো ঘড়ি দেখতেই জানে না। আর সেই সত্যটা অখিল আবিস্কার করেছিল অনেক পরেকয়েকবছর আগে যেদিন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন নিধুখুড়ো সকাল ১১ টা নাগাদ সন্ধ্যের চা-মুড়ি নিয়ে বসে পড়েছিল! আর তারপর গ্যাস-অম্বল বাধিয়ে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির একশেষ!
তারপর অখিল নিধুখুড়োকে একটা ঘড়ি কিনে দিয়ে সময় দেখা শেখাতে চেষ্টা করেছিল বটেকিন্তু সে চেষ্টা পুরোপুরি গঙ্গার জলে ভেসে গেছে!

সাধারণত প্রতিদিন এই সময়টা ঘুম চটকে যাবার পরে অখিল আর একবার  ঘুমোবার চেষ্টা করে থাকেকিন্তু আজ কেন জানি আর ঘুমোতে ইচ্ছে করল না!
আসলেকালই অখিলের কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছেতাই কাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঘন্টাচারেক ঘুমিয়ে পড়েছিলতাই সেই অর্থে আজ আর সেরকম ঘুম পাচ্ছে না।

ঘুম ভেঙ্গে খাটের উপর উঠে বসল অখিল। পাশে রাখা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ছোট্ট খুপরি জানলার পাশে রাখা জলের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে এই নিধুখুড়োর কথাটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
যখন সে জানত না যে খুড়ো ঘড়ি দেখতে জানে নাততদিন অবধি রোজ কাঁটায় কাঁটায় এই ভোরে উঠে চান করাআর সারাদিন যথাসময়ে দৈনন্দিন কাজকম্মগুলো করার মধ্যে কোনো আশ্চর্য ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সেই সূর্যগ্রহণের দিন থেকেই এটা অখিলকে ভাবাতে শুরু করেছিলএকটা মানুষ কি করে প্রতিদিন একটুও সময়ের ভুল না করে কাজ করতে পারে ঘড়ি দেখতে না জেনেওসেটা অখিলের কাছে সত্যিই অভাবনীয় ছিল!
কমার্সের ছাত্র হলেওঅখিলের সায়েন্সের দিকে একটা স্বাভাবিক ঝোঁক আছে। নিজের ইচ্ছেতেই ও বেশ কিছু সায়েন্সের বই পড়ে আর অল্পসল্প ইন্টারনেট ঘেঁটে বেশ কিছু তথ্য আর জ্ঞান অর্জন করেছিল। খুড়োর এই ব্যাপারটা চোখে পড়ার পর থেকেই তাই সে এটার কারণ খোঁজার পেছনে উঠেপড়ে লাগে। আর তার স্বভাবসুলভ অধ্যাবসায়ের ফলে মাসখানেকের মধ্যেই এর প্রাথমিক উত্তর অখিল পেয়েও যায়!
শারীরবৃত্তীয় ঘড়িবা বডি ক্লক জিনিসটা সম্বন্ধে তার ধারণা পরিস্কার হয় তখনই। আর নিধুখুড়োর বহুবিধ মজাদার কার্যকলাপ তখন বদলে যায় অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং ব্যাপারস্যাপারে!

কয়েক ঢোক জল খেয়ে বোতলটার ছিপি এঁটে জানলায় রাখার পরই অখিলের ব্যাপারটা খেয়াল হল!
কইঝপাস ঝপাস জলের আওয়াজআর সঙ্গে বেসুরো শ্যামাসঙ্গীতএগুলো তো শোনা যাচ্ছে না!
হুড়মুড় করে খাট থেকে নেমে চটিটা গলিয়েই অখিল হন্তদন্ত হয়ে বেরোলো দরজা দিয়ে। জানলা দিয়ে টিউবওয়েলটা দেখা যায় না, কারণ সেটা ওদের ঘরের পশ্চিমের দেওয়ালের পাশেই পড়ে বলেআর জানলাটা আছে দক্ষিণ দেওয়ালে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরতেই অখিলের চোখে পড়ল টিউবওয়েলটা।

ফাঁকাকলের নিচের শানবাঁধানো এবড়োখেবড়ো মেঝেটাও শুকনো!
আর, বাকি চারিদিক শুনশান – রোজ এসময়ে যেরকম থাকে, সেরকমই।

খানিক্ষণ ভেবলে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়াল হল, হাতঘড়িটা তো বালিশের পাশে খুলে রাখা আছে রোজকার মত। মাঝরাতে উঠে পড়লাম তাহলে – অখিল ভাবল!
ফিরে গিয়ে বালিশ সরিয়ে হাতঘড়িটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে তাকাতেই অখিল প্রায় পড়ে যাচ্ছিল! একি!! ঘড়িতে তো আটটা বাজে! চোখ কচলে নিয়ে আরেকবার তাকালো অখিল, দু-একবার ঝাঁকালো ঘড়িটাকে – নাঃ, এত সেই আটটাই দেখাচ্ছে!
পাশের ঘরে উঁকি মারল অখিল। ওর ভাই-বোন সেখানে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, বাবা কদিন ধরেই বাইরে আছে কাজের সূত্রে। আস্তে করে ঘরে ঢুকে দেওয়ালঘড়িটার দিকে তাকালো অখিল।
যাহ তেরিকা, এখানেও তো আটটাই দেখাচ্ছে!
আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের কলতলার শানবাঁধানো মেঝেতে হতভম্ভ হয়ে বসে পড়ল অখিল! তাহলে কি সারাদিন ঘুমোলো সে, যে একেবারে রাত আটটায় ঘুম ভাঙল?!
কিন্তু, তাহলেও তো, রাস্তায়, পাড়ায় লোকজনের ভিড়, দোকানপাটের ব্যস্ততা – এসব থাকার কথা! কই, চারিদিক তো শুনশান! মনে তো হচ্ছে মাঝরাত!

এবার একটু আতঙ্ক চেপে বসল মনে! এত শ্মশানপুরী মনে হচ্ছে! সবাই বেঁচেবর্তে আছে তো?
এটা মনে হতেই অখিল ধড়ফড় করে উঠে ছুটল বস্তির ভেতরের দিকে, স্বপনকে ডাকতে হবে! রকি বোধহয় নাইট ডিউটি করেছে কালকে, কিন্তু ভজন আর আঠার বাড়িতেই থাকার কথা! একছুটে স্বপনের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে টেঁপিদের ঘরের সামনে রাখা স্তুপাকৃতি টিনের বাক্সগুলো লাগল অখিলের কাঁধে।

বিকট খ্যানখ্যানে আওয়াজ করে হুড়মুড়িয়ে পড়ল গোটা স্তুপটা! সাড়ে সব্বনাশ, অখিল ভাবল, এবার তো গোটা পাড়া উঠে পড়বে ডাকাত পড়েছে ভেবে!
অখিল আর দাঁড়ালো না, ছুট লাগালো ডানদিকের গলিটা ধরে।


সুন্দর মহল, মেরিন ড্রাইভ, মুম্বাই, বুধবার

ঘুম ভাঙার পরও আলসেমিটা আজ যাচ্ছিল না কিছুতেই!

পরপর পাঁচরাত টানা কাজ করার ফল এটা, বুঝতে পারছিল রূপসা। কিন্তু কিছু করারও নেই – বড় বাজেটের ছবি, আর ওর এটা প্রথম বড় ব্রেক – হাড়ভাঙ্গা খাটুনিটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই তাই।
তবে আজ ছুটি, শ্যুটিং এর। পুরো ইনডোরের কাজটা শেষ হল কাল। এবার একটা তিনদিনের ছুটির পর কিছু অল্পস্বল্প ডাবিং আছে, তারপর সোজা মিশর, আউটডোর শ্যুটিং এর জন্যে।
মিশর!! ভাবতেই রূপসার বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল! এই ২২ বছর বয়সেই এরকম সুযোগ এসে যাবে, এটা একেবারে অভাবনীয় না হলেও, আশাতীত তো ছিল বটেই! সেই আনন্দে আজ ঘুমটাও তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে গেছে, নাহলে একটা ক্লিওপেট্রা মার্কা স্বপ্ন বেশ গড়গড়িয়েই দেখছিল রূপসা!

সুবোধ দা কে একটা হাঁক দিয়ে এককাপ কড়া কালো কফি বানাতে বলতে গিয়েও থেমে গেল রূপসা। নাঃ, আজ একটু নিজেই কফি বানানো যাক।
দশ মিনিট পর একটা বড় মগের সাইজের কাপে ধোঁয়াওঠা কফি নিয়ে, লাখ-পনেরো টাকা দিয়ে ছবির মত সাজানো বসার ঘরের টিভিটা খুলল রূপসা। অলসভাবে টিভির চ্যানেল বদলাতে বদলাতে, কফির কাপে হালকা চুমুক দিতে দিতে, সামনে রাখা ইকেবানা সম্বন্ধীয় ম্যাগাজিনটা হাতে তুলে ওলটাতে গিয়েও থমকে গেল রূপসা।

কি বলছে এটা, ব্রেকিং নিউজে!?
এসব কি উল্টোপাল্টা খবর বলছে?! কফির কাপটা তাড়াতাড়ি টেবিলে নামিয়ে রেখে টিভির চ্যানেল বদলালো – কিন্তু এটাতেও তো একই খবর, একই অদ্ভুতুড়ে কথা! পরপর আরো কয়েকটা চ্যানেল বদলালো রূপসা, কিন্তু সব চ্যানেলেই একই খবর!

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে, একবার দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো রূপসা, তারপর ধীর পায়ে উঠল। আস্তে আস্তে বিশাল স্লাইডিং দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে, খুব সাবধানে, বেলজিয়াম থেকে আনা ভারী কাপড়ের পর্দাটা হাল্কা একটু সরিয়ে তাকালো বাইরের দিকে!

ম্যাগাজিনটা হাত থেকে কখন খসে পড়েছে মেঝেতে, খেয়াল ছিলনা রপসার!

অবাক চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, যেখানে এখনো রাতের ঘন অন্ধকার, কিন্তু তার দেওয়ালঘড়ি, আর সমস্ত খবরের চ্যানেল বলছে – এখন সকাল সাড়ে দশটা!

সুরেলা শব্দে ফোনটা বেজে উঠতে সম্বিৎ ফেরে রূপসার। টেবিলের উপর রাখা মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে বাবার নম্বর – ফোনটা তুলে নেয় রূপসা।

“হ্যাঁ, বাবা”

“আরে, তোকে কতক্ষণ থেকে ফোনে চেষ্টা করছি, বেজেই যাচ্ছে, তুই কোথায়?!”

এঃ, ঘুম থেকে ওঠার পর তো ফোনটা আর দেখাই হয়নি!
“না বাবা, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিল!”

“আরে শোন, দেখেছিস কি উল্টোপাল্টা কান্ড হয়েছে!? আমি তো এদিকে সকাল থেকে, ইয়ে, মানে গত দু ঘন্টা ধরে বাবাইকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছি, এদিকে তারও কোনো ফোন লাগছে না! কি মুশকিল হল বল দেখি!”

“ওহ, তাই বুঝি! শোনো বাবা, আমি ঠিক আছি, বাড়িতেই আছি এখন। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি বরং একবার দেখি ভাইকে ফোনে পাই কিনা। রাখছি, পরে তোমায় ফোন করছি ওকে পেলে।“

ফোনটা কেটে দিয়ে রূপসার মনে হল যে এই ঝটকার পর থেকে তার মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে, নয়ত ভাইয়ের কথাটা আগে মনে পড়া উচিৎ ছিল তার।
রূপসা তার ফোন থেকে ভাইয়ের বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল।

বাবাই, পোষাকি নাম অভিক, রূপসার ছোট ভাই, কিছুদিন আগে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। প্রচন্ড মেধাবী ছাত্র, আর সেইমাত্রায় ডানপিটে! উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পরেই একটা চিঠি আসে বাড়িতে – কখন নিজের খেয়ালে কিসব এঁকেবুঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ই-মেলে, সেই আইডিয়া তাদের পছন্দ হয় – তাই নাসা থেকে তারা ডেকে পাঠায় অভিককে, এক মাসের জন্যে, ওয়াশিংটনে। গত মাসেই সে গেছে, এবং মাঝে মধ্যেই দিদিকে ই-মেল করে তার অ্যাডভেঞ্চারের কথা লিখে পাঠায়!
রূপসার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ভাইয়ের খোঁজ নেওয়া ছাড়াও, এই অদ্ভুত কান্ডের কারণটা নিয়েও সম্ভবত সেই আলোকপাত করতে পারবে!

নাঃ, কলটা বাবাইয়ের ভয়েস মেসেজে চলে গেল। রূপসা ভাবল যে একটা মেসেজ ছেড়ে রেখে দেবে, কিন্তু তার আগেই লাইনটা কেটে গেল নিজে থেকেই!

ফোনটা হাতে নিয়ে রূপসা ফিরে এল টিভির সামনের সোফাতে, আর সরিয়ে রাখল দরজার সামনের পর্দাটা। টিভির পর্দায় ক্রমাগত দেখিয়ে যাচ্ছে ব্রেকিং নিউজ – গোটা দেশজুড়ে রাত্রির অন্ধকার, সমস্ত লোকজন ভেঙে পড়েছে রাস্তায়, বহু লোকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, মন্দিরে-মসজিদে, বিভিন্ন পূণ্যস্থানে পুজো দেবার হিড়িক লেগেছে, রাস্তায় নেমেছে পুলিশ, এমনকি মিলিটারিও!
বিভিন্ন চ্যানেলে ভেসে আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছবি, লোকে লোনারণ্য শহর-গ্রামের রাস্তাঘাট।
কলকাতা চিড়িয়াখানার পশু-পাখিদের আচরণে অদ্ভুত ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে কিছু চ্যানেলে দাবী করছে!
হঠাত রূপসার খেয়াল হল – তাই তো, মেনি গেল কোথায়!?
একছুটে ঘরে ঢুকল রূপসা – নাহ, মেনি তার জায়গায় নেই, টেবিলের উপর বাস্কেটটা ফাঁকা! ঝুঁকে খাটের তলায় উঁকি মারল রূপসা, কিন্তু না, সেখানেও নেই মেনি! সব্বোনাশ, গেল কোথায় সে!
রান্নাঘর? ছুটল সেখানেও রূপসা, কিন্তু সেখানেও তার টিকিটি দেখা গেল না!!
এইবার যখন তার মাথায় হাত দিয়ে বসার উপক্রম, তখনই খেয়াল হল রূপসার! সোজা আবার বসার ঘরে ছুটে গেল সে, আর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বইয়ের আটফুট উঁচু তাকের উপর উঁকি মারল। 
যা ভেবেছিল তাই, মেনি তাকের উপর এক কোনায় গুটিসুটি মেরে সেঁধিয়ে আছে! ভাগ্যিস, রূপসার মনে ছিল, আগের বার সেই কানফাটানো বাজ পড়ার পরে সুবোধ দা এখান থেকেই খুঁজে বার করেছিল মেনিকে!
হাত বাড়িয়ে ঘেঁটি ধরে মেনিকে টেনে আনতে হল  রূপসাকে। শেষমেষ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে তার ফ্যাঁসফ্যাঁসানি কিছুটা শান্ত হল!
ধীরপায়ে বসার ঘরে ফিরে এল রূপসা – মেনিকে চেয়ারের উপর রাখা তাকিয়ার উপর বসিয়ে দিয়ে সে গিয়ে দাঁড়ালো স্লাইডিং দরজার পাশে। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে প্রায় পুরো শহরটা দেখতে পাচ্ছিল রূপসা, আর ভাবছিল – আজ সে কিছুটা আতঙ্কিত, এবং তার থেকেও বেশী হতভম্ব, কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে, বা গ্রীনল্যান্ডের মত জায়গায়, অথবা উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া অভিযাত্রী দলগুলো – সেখানকার মাসছয়েকের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলো তো সেখানকার বাসিন্দাদের অসাচ্ছ্যন্দে ফেলে না!
আসলে, অভ্যেসের থেকে আলাদা কিছু, রোজকার রুটিনের থেকে অন্য কিছু – এগুলোই আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

এই উপলব্ধিটা এই অদ্ভুত মূহুর্তেই হতে হল!
সকাল এগারোটায় এই রাতের অন্ধকারের মধ্যেও হাসি ফুটে উঠল রূপসার মুখে।


মল্লিকঘাট, কলকাতা, বুধবার

গঙ্গার ঘাটে সুন্দর মৃদুমন্দ হাওয়ায় অখিলের পাঞ্জাবির কোনাটা উড়ছিল। ওরা পাঁচজন বসে ছিল ঘাটের সবথেকে নিচের সিঁড়িটাতে – স্বপন, রকি, ভজন, আঠা আর অখিল। সামনে গঙ্গার ওইপার থেকে নতুন সূর্যটা উঁকি মেরেছে এই কিছুক্ষণ আগে, এখনো যার মধ্যে হলুদ ভাবটা লেগে আছে।
ঘড়িতে এখন রাত দশটা প্রায়। সকলের চোখেমুখে গত দশ-বারো ঘন্টার মানসিক ধকলের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তার সঙ্গে অখিলের চোখে লেগে আছে এক অন্য মুগ্ধতা, আর সঙ্গে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি।

মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল কিছু সারস। মাছধরা জেলেনৌকোগুলো দাঁড় টেনে চলেছে গঙ্গার মাঝের দিকে।

মোবাইল ফোনটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালো অখিল – এবার ফিরতে হবে। আজ এক নতুন দিন, নতুন সময়ের সঙ্গে অখিলও খুঁজে পেয়েছে তার নতুন লক্ষ্য!


সুন্দর মহল, মেরিন ড্রাইভ, মুম্বাই, বুধবার

সাদা ঝকঝকে ফোনটা ফোনটা তখনো হাতে নিয়ে বসে ছিল রূপসা। এই মিনিট পনেরো হল বাবাইয়ের ফোনটা এসেছিল। ভাইয়ের কথাগুলোই এখনো ভেবে যাচ্ছিল সে।
খুব উত্তেজিত শোনাচ্ছিল ভাইয়ের গলা, যখন ফোন করেছিল।

“জানিস দিদি, আমাদের পৃথিবীটা আজ, মানে তোদের মাঝরাত নাগাদ, আস্তে আস্তে ঘোরা থামিয়ে, আবার উল্টোদিকে ঘোরা শুরু করেছিল, আর তার ফলেই এই উল্টোপাল্টা অবস্থা!”
উল্টোদিকে ঘুরছে মানে!!! শুনে রূপসারই মাথা কোনদিকে ঘুরতে শুরু করেছিল সেটা আর এখন খেয়াল নেই!
“এই ব্যাপারটা নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক বিজ্ঞানীরা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন কারণটা খুঁজে বার করতে। কিন্তু সবথেকে বড় ব্যাপার কি জানিস! আমি তখন সবে লাঞ্চ করতে করতে আমার ই-মেল দেখছিলাম। দেখলাম একটা মেল এসেছে ইন্ডিয়ার একটা ছেলের থেকে। এর সঙ্গে মাস ছয়েক আগে কলেজ স্ট্রীটে বই কিনতে গিয়ে আমার আলাপ হয়েছিল। পৃথিবীর চৌম্বকমেরু অদলবদল নিয়ে এক বিজ্ঞানীর একটা থিয়োরির বই খুঁজছিল, খুব অবাক হয়েছিলাম ওরকম অদ্ভুত কৌতুহল দেখে! সেই সুত্রেই আলাপ হয়েছিল – আমি বলেছিলাম পেলে আমি ওকে ই-মেল করে দেব। সে-ই আজ একটা মেল করেছিল আমাকে, যেখানে থেকেই আমি জানতে পারি যে ইন্ডিয়ায় সকাল দশটাতেও রাতের অন্ধকার। তখনই আমি ছুটি আবার প্রফেসরের ডেস্কে। কিন্তু সবথেকে অদ্ভুত জিনিস কি জানিস দিদি? ও মেলে লিখেছিল যে সেই বিজ্ঞানীর থিয়োরি থেকে ওর মনে হচ্ছে যে পৃথিবীর উল্টোদিকে ঘোরার একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে, যেটা সাধারণত ২ লক্ষ্য থেকে ৩ লক্ষ্য বছর পরে পরে হবার সম্ভাবনা।  আমি এই কথাটা আমার প্রফেসরকে বলেছিলাম গিয়ে। কথাটা যে ভুল নয়, সেটা তো দেখাই গেল! ভাবতে পারছিস দিদি, ইন্ডিয়ার এক বস্তিতে থাকে ওই ছেলেটা, সেরকম কোনো সুযোগসুবিধে নেই পড়াশুনো করার, অথচ কি দুর্দান্ত জ্ঞান আর কিউরিওসিটি!

বাবাই আরো খানিক্ষণ বকবক করেছিল উত্তেজিত স্বরে।  রূপসা বুঝতে পারছিল ভাইয়ের এই উত্তেজনার কারণ – এই বয়সে, যখন স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল তুঙ্গে থাকে, সেই সময়ে আমেরিকাইয় নাসায় বসে এরকম একটা যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পরেও যে ও মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে সেটাই বেশ অবাক ব্যাপার! সেই তুলনায় প্রথম সিনেমায় ব্রেক পাবার পর রূপসা তো লাফাতে গিয়ে পড়ে পা-ই মচকে ফেলেছিল – রোলটাই প্রায় হাতছাড়া হবার যোগাড় হয়েছিল!

বাবাই আরো কিছু বলেছিল – কিভাবে এখন সময়ের হিসেব করা হবে, বা দিনক্ষণ-তারিখেরই বা কি হবে – কিন্তু সেসব ভালো করে মাথায় ঢোকেনি রূপসার। আপাতত সে এটাই বুঝেছে যে, পৃথিবী অন্যদিকে ঘুরুক বা রাত দশটায় সূর্য সবে হলুদ থেকে সাদা হোক, পেট তার নিজের কাজ করে যাবে!
কি অদ্ভুত – ভাবল রূপসা!
নাহ, ফ্রিজে ডিম আছে, আর একটু নুডলস – একটু চাউমিন বানানোই যেতে পারে। আরেকবার পেটটা ডাকার আগেই উঠে পড়ল রূপসা, রান্নাঘরের দিকে – পায়ে পায়ে লেগে থাকা মেনির ল্যাজ বাঁচিয়ে।


ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দিল্লী
নতুন বার

গত বারো ঘন্টায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে বিমান চলাচল। কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্যে বসে বসে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ফ্লাইট বাতিল হবার ঘোষণা আর চারিদিকের শোরগোল শুনে ঘুম ভেঙে দেখি এই কান্ড!

ব্রাতিস্লাভা ফিরে যাচ্ছি আজ মাসদুয়েক কলকাতায় কাটানোর পর। জানি না আবার কবে ফিরব! সামনে অনেকগুলো কাজ, লম্বা সময় ধরে অনেকগুলো ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্ট আছে, ইউরোপের বেশ কিছু অংশও ঘুরতে হবে সেই সুত্রে।
আর আধঘন্টাখানেক পরই প্লেন ছাড়বে – দুবাই হয়ে ব্রাতিস্লাভা – লম্বা সফর।

ফোনটা পকেটে নড়েচড়ে উঠল, হোয়াটস্যাপে বোধহয় মেসেজ এল! ফোনটা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে মনে পড়ল, কলকাতায় এয়ারপোর্টে বসে থাকতেই ফোনটা এসেছিল।
প্রথমে খানিক ইয়ারকি-ফাজলামি, হাল্কা ঝগড়াঝাটি। তারপর খানিক্ষণ এদিক-ওদিক কথাবার্তা চালানোর পর আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা বাড়ছিল!
আমি বললাম, ওখান থেকে ছবি পাঠাবো, অদ্ভুত সুন্দর সব জায়গার।
খানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলেছিল – “আচ্ছা”!
তারপর কয়েকটা লম্বা নিঃশব্দ শ্বাস ছাড়ার পর বলেছিল – “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, তারপর একদিন সারাদিন বসে গল্প শুনব তোমার অ্যাডভেঞ্চারের”!


নাহ, সূর্যটা আজ সত্যিই পশ্চিমদিকেই উঠেছিল!


নিজের অজান্তেই হেসে পকেটে আবার ফোনটা ঢুকিয়ে রাখলাম। ব্যাগকাঁধে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম প্লেনের দিকে।

10 comments:

  1. আমি অনেক কিছু বলতে চাই। পড়ার শুরুতে, কেমন যেন একটা ফেলে আসা নস্টালজিক কলেজ জীবনের আঁচ পাচ্ছিলাম। কয়েক লাইন পর থেকে, নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করল লেখাটা। আমি যখন লিখতাম, তখন উদ্ভট কিছু বিষয় নিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছি। আরো অনেক কিছুর মতই সফল হইনি। এই লেখাটা আমায় বুঝিয়ে দিয়ে গেল, সাফল্যের চাবিকাঠি আসলে কোথায়। সহজিয়া লেখা। সহজ সরল। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভেতর থেকে উঠে আসা। সেখানে মিলে গেছে ফ্যান্টাসি কল্প-বিজ্ঞানের ফোড়ন। অনবদ্য লেখা। শুধু এই লেখার আঙ্গিকের জন্যে আমি একটা বড় সেলাম জানাই লেখক কে।

    চিনে কালি তে আঁকা চিনে ছবির মতই এখানে ওখানে দু চারটে আঁকিবুঁকি কেটে চরিত্র গুলো তৈরি। চরিত্রের বাকিটুকু নির্মানের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দেওয়া। আর এখানেই বাজিমাত। পাঠক জড়িয়ে যাচ্ছে গল্পের সঙ্গে। মল্লিক ঘাটে সারস উড়ে যাওয়া, জেলে নৌকো কিম্বা পাড়ার গলির মুখের টিউবওয়েল, যে টুকু বর্ননা ,সে টুকু অসামান্য দক্ষতায়। কোথাও মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি।

    বাকি রইল কল্পনার অংশটুকু। সেখানে বিরাট মহাকাশযান কিম্বা ডায়নোসর ছাড়াই স্রেফ উলটো দিকে ঘুরপাক খাইয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের সকলকে। আর এতেই বাজিমাত। তুখোড় লেখা। এ লেখা অনেক অনেক বেশী পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছবার এবং আদৃত হবার ন্যায্য দাবী রাখে।

    ReplyDelete
  2. লিখে তো ভালো লাগেই, তবে তার থেকেও বেশী আনন্দ হয় যখন লেখাটা পড়ে পাঠক লেখকের ভাবনাটা ধরতে পারে! সেইরকমই আনন্দ পেলাম তোমার মন্তব্যটা পড়ে!

    নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে বেরিয়ে এই লেখাটা লিখতে চেষ্টা করেছিলাম, এবং সেই জায়গায় লেখাটা নিয়ে আমি একটু দ্বিমত পোষণ করব তোমার থেকে। ☺
    আসলে, ঠিকই যে পাঠক-পাঠিকার কল্পনাটা উসকে দেওয়াটা একটা উদ্দেশ্য ছিল ঠিকই, তবে আরো কিছু তথ্য বা দরকারী বিষয় দিলে লেখাটা পাঠকের কৌতূহল আরো ভালোভাবে উসকে দিতে পারত, যেটা তোমার লেখায় থাকে (এবং যার ফল আমার নিজের কৌতূহল )। কিন্তু জ্ঞান এবং গপ্পের সাবলীল মিলমিশ করার মত মুন্সিয়ানা এখনো আমার আয়ত্তের বাইরে। হয়ত কোনদিন হবে!

    তবে এই মন্তব্য আমার পরের লেখাটা বার করবে এটুকু বলতেই পারি ☺

    ReplyDelete
  3. অদ্ভুত লাগলো গল্প টা।এভাবে যে কলকাতার অলিগলি থেকে বেডিয়ে হঠাৎ গল্প টা কল্প বিজ্ঞানের পথে হাটবে ভাবতে পারিনি।এত সহজ সরল কথায় কল্পবিজ্ঞানের গল্প এক সত্যজিৎ রায় ছাডা কেউ লিখেছে বলে জানিনা।লেখার ধরন আর কল্পনা দুটোই অসাধারণ।আর একটা ছোট্ট বিষয় আমার মনে দাগ কেটেছে যখন রূপসার উপলব্ধি হয় যে ওর ভাই এর সাফল্যের কাছে ওর সাফল্য টা কিছুইনা তবু ওর ভাই সাফল্যের শির্ষে পৌছে ও কত সহজ সরল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সরলভাবে বলতে চেয়েছিলাম, সেটা যে তোমাদের ভালো লেগেছে, দেখে আনন্দিত হলাম ☺

      আমি নিজেও অনেকসময়ে সচেতনভাবে সব স্তরগুলো লিখি না, হয়ত অবচেতনে চলে আসে - সেটা যখন পাঠক-পাঠিকা ধরতে পারে, অত্যন্ত পরিতৃপ্তির ব্যাপার হয়।

      সত্যজিৎ রায় অসামান্য মানুষ, আমার আইডল অনেক বিষয়ে। সুতরাং লেখায় একটা ছাপ পড়েই, যদিও অত্যন্ত বেখাপ্পা ছাপ!

      Delete
  4. Khub bhalo legechhe. Jante ichchhe korchhe, prithibir ulto dike ghora niye ei idea ta kiser theke mathay elo

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ।

      আমি আর্থার সি ক্লার্কের বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান ছোটবেলায় পড়েছিলাম, বাংলা অনুবাদ। সেখানে খুব সামান্য কিছু কল্পবৈজ্ঞানিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই অসামান্য কিছু গল্প লেখা ছিল। সেইটা এই ধরনের minimalistic বিষয় ভাবার পেছনে অনুপ্রেরণা বলতে পারো।

      তবে পৃথিবী উল্টোদিকে ঘোরার ব্যাপারটা মাথায় এসেছিল একদিন লন্ডন যাবার প্লেনের শিডিউল দেখতে গিয়ে - ঘন্টাদশেকের যাত্রা হলেও সময়ের হেরফের মাত্র কয়েক ঘন্টার, সেইটা থেকেই আসে ভাবনাটা।

      Delete
  5. তোমার লেখায় সবসময় একটা নতুন চমক থেকে এটাও তার বাইরে নয়। নিধুখুড়োকে নিয়ে ভাবনা শেষ করার আগেই গল্পের মোড় অন্যদিকে বাँক নিল। শেষ হল সহজ সরল অথচ অকল্পনিয় এক কল্পবিঞ্জানের কাহিনী রূপে । সাধারণ একটা ভাবনার অসাধারণ পরিসমাপ্তি । টুকরো টুকরো দৃশ্যপটের ছন্দপতন ঘটেনি কোথাও। সবচেয়ে ভালোলাগল পাঠক/পাঠিকাদের জন্য বৃস্তিত ভাবনার জায়গা রাখা আছে এই লেখাতে। অনবদ্য লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ সুদীপ্ত দা, অনেক ধন্যবাদ। ☺

      আসলে, আমি যেরকম বিষয় নিয়ে লিখে থাকি, তার থেকে একটু বেরোতে চাইছিলাম। মানে, comfort zone থেকে বাইরে এসে লেখা। আর সেক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনটা যে ভালো লেগেছে, সেটা বড় প্রাপ্তি বটে।

      Delete
  6. তোর সব লেখায় প্রথম থেকেই একটা সহজ সাবলীলতা আছে যেটা আমার খুব প্রিয় । এই লেখাটাও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে কল্প বিজ্ঞান টা উপরি পাওনা । এই গল্পটা শীর্ষেন্দু র একটা ছোট গল্প মনে পরিয়ে দিল যেখানে কলকাতায় বরফ পড়েছিল চুম্বকীয় মেরু উল্টে যাবার জন্য । আমি জানি কল্প বিজ্ঞান তোর পছন্দের subject তাই আরো কিছু লেখার অপেক্ষায় রইলাম ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ভাই ☺ আসলে প্রতিবার একই লিখলে গালি পড়বে, তাই এট্টু কল্পগল্প আনলুম!
      তোর শীর্ষেন্দুর গল্পটা মনে আছে!? ব্যাপক, কারণ লেখার বেশ কিছুদিন আগে আমারও ওটা মনে পড়েছিল এই সূত্রেই।

      Delete